সালতামামি

বোল্টের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বিদায়

ঠিক একে অনাকাঙ্ক্ষিত বলাটা হবে অযৌক্তিক। কারণ, ২০১৬ রিও অলিম্পিকের সময়েই তো বলে দিয়েছিলেন, ২০১৭ লন্ডন অ্যাথলেটিক মিটে হবে তার ক্যারিয়ারের শেষ দৌড়। এরপরই স্পাইকজোড়া শো কেসে সাজিয়ে রাখবেন তিনি; কিন্তু ‘শরীর তো আর এসব ধর্মের কাহিনী শোনার মত নয়’। শরীরেরও তো একটা নিজস্ব ধর্ম আছে। সেই ধর্ম মেনেই শরীর নিজেকে পরিচালিত করে। এর অন্যথা হলে, গড়বড় করবেই। সে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হোক কিংবা আফ্রিকান অনুন্নত কোনো দেশের কুঁড়েঘরে দিনাতিপাত করা কোনো অসহায় মানুষ হোক।

Advertisement

বিশ্বের দ্রুততম মানব হওয়া এবং সেই খেতাব পারফরম্যান্স দিয়ে বছরের পর বছর ধরে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। এর জন্য কঠোর পরিশ্রম আর কঠিন অধ্যাবসায়ের প্রয়োজন হয়। উসাইন বোল্টকে যে প্রতিটি ক্ষণ এবং প্রতিটি মুহূর্তে এমন কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হতো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

মাত্র ১০ সেকেন্ডেরও কম সময়ের একটি দৌড়। ক্ষণিকের জন্য অন্যদিকে চোখ ফেরালেই দ্বিতীয়বার আর দেখার সুযোগ নেই। চোখের পলকে শেষ হয়ে যায় বিশ্বের সবচেয় আকর্ষণীয় ইভেন্টের জমজমাট লড়াই। উসাইন বোল্ট তো অ্যাথলেটিকের ১০০ মিটার স্প্রিন্টকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য মাত্রায়, অন্য উচ্চতায়। ১০০ মিটার স্প্রিন্ট হবে, সেই স্প্রিন্টে প্রতিযোগি বোল্ট- দুইয়ে দুইয়ে যে রসায়ন তৈরি হতো, তার আকর্ষণকে এড়িয়ে যাওয়া বিশ্বের কোনো ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়।

সর্বকালের সেরা অ্যাথলেটের আসনে বসিয়ে দেয়া যায় এখনই। বোল্ট নিজেও জানতেন, সময়ের সেরা তিনি। তার একটাই কথা শেষ দিকে এসে সব সময় উচ্চারিত হতে শোনা গিয়েছে। ‘আমি পেলে-আলির মত হতে চাই।’

Advertisement

বক্সিংয়ের কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলি ক্লে কিংবা ফুটবলের কিংবদন্তি পেলে- নিজ নিজ ক্রীড়াঙ্গনের গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে পড়েছেন বিশ্বজনীন। যে কোনো ইভেন্ট, যে কোনো খেলাধুলার ক্ষেত্রে তারা এমন এক আসনে নিজেদের পৌঁছে দিয়েছেন, সেখানে অন্যরা সবাই শুধু ওঠার আকাঙ্খাই করতে পারে। তাদের ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে।

উসাইন বোল্টও পেলে-আলিকে ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেন। নিজের ক্যারিয়ারে যা করার তিনি করে দিয়েছেন। এখন তাকে পেলে-আলির কাতারে পৌঁছে দেবে সময়। সময় যত গড়িয়ে যাবে তত বোল্ট পরিণত হবেন রূপকথার এক মহা নায়কে। পরবর্তী প্রজন্ম শুনবে শুধু, বার্লিন (২০০৯ সালে) অ্যাথলেটিক ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ১০০ মিটারে ৯.৫৮ সেকেন্ডের অতি মানবীয় দৌড়ে বিশ্বজয় করেছেন উসাইন বোল্ট।

৯টি অলিম্পিক সোনা (একটি আবার সতীর্থের ডোপিং কেলেঙ্কারির কারণে বাদ দেয়া হয়েছে, এ কারণে এখন ৮টি)। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে- এমন ঈর্ষণীয় সাফল্য তো বলতে গেলে কার্ল লুইসেরও নেই। লুইসও ৯টি অলিম্পিক সোনা জিতেছেন। তবে বোল্টকে লুইস থেকে আলাদা করে দিয়েছে অন্য একটি বিষয়। বোল্ট সবগুলো সোনা জিতেছেন কেবল স্প্রিন্ট থেকে; কিন্তু কার্ল লুইস ৯টি সোনার মধ্যে ৪টিই জিতেছেন লং জাম্প থেকে।

তবে বোল্টের আদর্শ মোহাম্মদ আলির জীবনে সাফল্যের জয়জয়কার যেমন আছে, তেমনি ব্যর্থতার গল্পও আছে। তার বিখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজন জো ফ্রেজার। যার বিপক্ষে আলির লড়াইকে নাম দেয়া হয়েছে ‘ফাইট অফ দ্য সেঞ্চুরি।’ ১৯৭১ সালে সেই ফাইট অব দ্য সেঞ্চুরিতে কিন্তু ফ্রেজারের কাছে হেরে গিয়েছিলেন আলি। ৩৫ বছর যিনি বক্সিংয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সেই আলি হেরে গেলেন জো ফ্রেজারের কাছে!

Advertisement

‘থ্রিলা ইন ম্যানিলা’ কিংবা ‘দ্য র‌্যাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’- মোহাম্মদ আলিকে বিখ্যাত করে দিয়েছে। তার বিখ্যাত লড়াই আরও আছে। অথচ ফাইট অব দ্য সেঞ্চুরিতে হেরে গেলেও সেই লড়াইটাই যেন তাকে আরও বেশি কিংবদন্তির আসনে বসিয়ে দিয়েছে। পূর্বসূরির দেখানো পথেই কী তবে হেঁটে এসে অ্যাথলেটিক ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড থেকে বিদায় নিয়েছেন বোল্ট!

২০১৭ লন্ডন বিশ্ব অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশিপে শেষ দৌড় দেবেন। বোল্টের বজ্রগতির শেষ দৌড় দেখার জন্য প্রায় ৮০ হাজার দর্শকে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল ৫ আগস্ট। বোল্টের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী জাস্টিন গ্যাটলিন এবারও তার জন্য বড় হুমকি। ইনজুরিতে জর্জরিত হওয়ার পরও শেষ দৌড়টা দেয়ার জন্য তিনি দাঁড়ালেন স্টার্টিং পয়েন্টে। সিগন্যালের সাথে সাথেই দৌড় শুরু। কিন্তু শুরুটা তার এত বাজে হলো যে, শেষ মুহূর্তে আর গ্যাটলিনকে পেছনে ফেলতে পারেননি। ৯.৯২ সেকেন্ড সময় নিয়ে বোল্টের কাছ থেকে শিরোপা কেড়ে নিলেন গ্যাটলিন। এমনকি বোল্ট দ্বিতীয়ও হতে পারলেন না। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক স্প্রিন্টার ক্রিশ্চিয়ান কোলম্যান ৯.৯৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে জিতে নিলেন সিলভার এবং ৯.৯৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে বোঞ্জ জিতলেন বোল্ট।

দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী জো ফ্রেজারকে যেভাবে হারাতে হারাতে শেষ পর্যন্ত ফাইট অব দ্য সেঞ্চুরিতে হেরেছিলেন মোহাম্মদ আলি, তেমনি জাস্টিন গ্যাটলিনকে হারাতে হারাতে শেষ পর্যন্ত একেবারে শেষ দৌড়ে এসে সেই গ্যাটলিনের কাছেই হেরে গেলেন বোল্ট! যদিও এরপরের দৃশ্যটি ছিল অভাবনীয়, অকল্পনীয়। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাটলিন। পুরো ক্যারিয়ারে যে বোল্ট তাকে শুধু পরাজয়ের স্বাদই দিয়ে গেছে, সেই বোল্টকে হারানোর পর যেখানে বুনো উল্লাসে মেতে ওঠার কথা মার্কিন এই দৌড়বীদের। সেখানে এসব না করে দিনি সোজা চলে আসলেন বোল্টের সামনে। হাঁটু গেঁড়ে বসে বোল্টের সামনে মাথা নিচু করে হাত দুটি সোজা বাড়িয়ে ধরলেন। কিংবদন্তিকে জানালেন বিদায়ী অভিবাদন। বোল্টও সাদরে গ্রহণ করলেন সেই অভিবাদন। গ্যাটলিনকে হাত ধরে টেনে তুলে ঠাঁই দিলেন নিজের বুকে। সত্যিই অভাবনীয় এক দৃশ্য। শত বছরেও এমন সম্প্রীতির দৃশ্যের দেখা পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।

এরপর দু’জনই মিলিয়ে গেলেন বিজয়ানন্দে। গ্যাটলিনের সঙ্গেই দিলেন ল্যাপ অব অনার। হেরেও যেন বিজয়ী বোল্ট। পুরো অলিম্পিক স্টেডিয়ামের গ্যালারি দাঁড়িয়ে স্ট্যান্ডেনোভেশন জানালেন জ্যামাইকান কিংবদন্তিকে।

বিদায় পর্বটা এ পর্যায়ে থেমে গেলো ভালোই হতো। ট্র্যাজেডি গড়ার সুযোগ হয়তো পেতো না নিয়তি। কিন্তু একেবারে সর্বশেষ দৌড়ে এসে পরিণত হলেন ট্র্যাজিক হিরোয়! এতটাই যে, বোল্টের এই ট্র্যাজেডি লেখা হয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়। অথচ যারা বিজয়ী হয়েছে, তাদের কথা মানুষ মনেই রাখবে না।

নিজের আরেক প্রিয় ইভেন্ট ২০০ মিটারে অংশ নেননি বোল্ট। নিয়েছেন ১০০ মিটার রিলেতে। এখানেও গত বেশ কয়েকবছর তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এবারও ফেবারিট তিনি। শেষটা স্বর্ণ জিতে সোনালি আলোয় রাঙিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। রিলে যেহেতু চারজনের দৌড়। শেষ ফিনিশিংটা দেন বোল্ট নিজে। এবারও তেমনই হওয়ার কথা। ১২ আগস্ট ছিল সেই দিনি। জুলিয়ান ফোর্তের কাছ থেকে ব্যাটন নিয়ে দৌড় দেয়ার পরই কী আশ্চর্য, মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন বোল্ট। হ্যামস্ট্রিংয়ের ইনজুরিতে আক্রান্ত হলেন।

স্বাভাবিকভাবেই স্বর্ণ জয়ের প্রশ্ন আসে না। তবে স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরেও গেলেন না। সতীর্থদের কাঁধে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করলেন। আহত বীরের মত যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে দাঁড়াননি। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে গিয়েছেন। কিংবদন্তিদের অভিধানে বুঝি সরে দাঁড়ানো কিংবা পালিয়ে যাওয়া বলতে কোনো শব্দ নেই! বোল্ট তো সেটাই দেখালেন।

বজ্রের গতিতে যার উত্থান, দীর্ঘদিন যিনি শাসন করেছেন অ্যাথলেটিক ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড, তিনি শেষ পর্যন্ত বিদায় নিলেন সতীর্থের কাঁধে ভর দিয়ে। তার এমন অনাকাঙ্খিত বিদায় কেউ চায়নি। কেউ কল্পনাও করেনি; কিন্তু নিয়তির কাছে তো হার সবাকেই মানতে হয়। সেটা মেনেই বুটজোড়া চির জীবনের জন্য তুলে রাখলেন উসাইন বোল্ট।

আইএইচএস/আরআইপি