ভ্রমণ

পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : নবম পর্ব

আজ আমাকে আটাশ কিলোমিটার দূরের কাশিয়ানী পর্যন্ত যেতে হবে। তাই একটু ভোরেই বের হয়েছি। সাথে আছেন সবুর সাব। তিনি বললেন, নড়াইলে যেহেতু এসেছ, মাশরাফির বাড়ি না দেখেই যাবে? চলো তার বাড়ি হয়েই যাই। আমরা মাশরাফি বিন মর্তুজার বাড়ি গেলাম। কিন্তু তাকে পেলাম না। তিনি ঢাকায় আছেন। তিনি যে মাঠে শৈশবে খেলাধুলা করেছেন সেই মাঠেও নিয়ে গেলেন আমাকে। ক্রিকেট পাগল কোটি মানুষের প্রাণের স্পন্দন তিনি। যে মাঠে তার শৈশব কেটেছে সেই মাঠ নিঃসন্দেহে তার সফলতার অংশীদার।

Advertisement

চিত্রা নদীর ঘাট পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিয়ে সবুর ফিরে গেলেন। এখানে নদী পারাপারের জন্য কোন ব্রিজ নেই। তাই সবাই নৌকা করেই পার হয়। ছোট নৌকায় আমরা প্রায় দশ-বারো জন যাত্রী উঠেছিলাম। একটা মোটরসাইকেল, ছাগল ও হাঁস-মুরগীও ছিলো যাত্রী হিসেবে। প্রায় সবাই কৌতূহল নিয়েই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একজন ভদ্রলোক খুব আগ্রহ নিয়েই আমাকে জানতে চাইলেন। আমি আগ্রহ নিয়েই বললাম। ফলে নৌকার সবাই জেনে গেলো আমার পদযাত্রার কথা। নদী পার হয়ে যখন সবাই দুই টাকা করে ভাড়া দিচ্ছে; তখন আমিও ভাড়া দিতে চাইলাম। কিন্তু আমার ভাড়া নিলেন না। নৌকায় করে নদী পার হয়ে একাই হাঁটা শুরু করলাম। ভোরে তেমন কুয়াশা ছিল না। দিন যত বাড়ছে, কুয়াশা চারপাশ ধোঁয়াটে করে তুলছে। ভোরে বের হওয়ার সময় খেয়ে বেরিয়েছিলাম। সবুর সাহেবের স্ত্রী সেই রাত থাকতেই খাবার রান্না করেছিলেন। তাই আর এখন খাবারের চিন্তা নেই। এখন শুধু হাঁটা আর হাঁটা।

বড় একটি গাছের ছায়ায় একটি ছেলে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ক্লান্ত। দূর থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে যেতেই আমাকে থামালেন। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে হয়তো। প্রথম দেখাতেই বুঝতে পারলাম ছেলেটি অসুস্থ। আমার আজ লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে, তাই দাঁড়িয়ে কথা বলার আগ্রহ দেখালাম না। তবে সে আমার সাথে হাঁটার আগ্রহ প্রকাশ করলো। হাঁটতে হাঁটতে কথা হলো তার সাথে। তার নাম মোহাম্মদ সাঈদ। অল্প বয়সেই স্ট্রোক করে তার ডান হাত-পা কিছুটা অবশ হয়ে গেছে। বেশি সময় হাঁটতেও পারে না। দাঁড়িয়ে থাকতেও শরীর কাঁপে। আমি তাকে আমার সাথে হাঁটতে না করলাম। তবু সে বললো, ছোট ভাই তোমার সাথে হাঁটতে ভালো লাগছে। আর একটু পথ তোমার সাথে হাঁটি। সে আমার সাথে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ হেঁটেছে।

রাস্তার পাশে স্বপ্নবীথি নামে একটা পার্ক দেখতে পেলাম। পার্কের গেইটের দুপাশে দুটো দৈত্যের মূর্তি আছে। দৈত্যের গায়ের রং কালো, ভয়ংকরভাবে হাঁ করে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। উপরেও ভয়ংকর জন্তু। একটা বিনোদনমূলক স্থানে ঢোকার পথেই যদি এরকম ভয়ংকর কিছু থাকে; সেখানে বিনোদনের আর কী থাকে? ছোট ছোট শিশুরাও এখানে আসে। তাদের মনে এরকম ভীতিকর কিছু না থাকলেই বেশি ভালো হতো বলে আমার মনে হয়। পার্ক কর্তৃপক্ষ কী মনে করে এসব করেছে তারাই ভালো জানেন। এসব নিয়ে আমি যতই ভাবি না কেন, কোন কাজে আসবে না।

Advertisement

যা হোক, সাঈদ এখান থেকে আলাদা পথ ধরবে। তাই তার সাথে বিদায় পর্বের কথা হচ্ছে। সে বললো, ভাই আমি এতটুকু পথ সর্বশেষ কবে হেঁটেছিলাম মনে নেই। স্ট্রোকের পর আজ প্রথম এতটুকু পথ হাঁটলাম। তোমাকে পেয়ে বুকে সাহস পেয়েছি। সেই সাহসেই হাঁটতে পারলাম। তোমার যাত্রা শুভ হোক। আমি কোন কথা বলার সাহস পেলাম না। কারণ আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। চোখ দুটো দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি আবার কারো চোখে জল দেখতে পারি না। তার উৎসাহ আমাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি আরো বাড়িয়ে দিলো।

লক্ষ্মীপাশা বাজারে এসে দুপুরের খাবারের জন্য থামলাম। সকাল থেকে প্রায় সতেরো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছি। দেখতে দেখতে আমার চারপাশে কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমে গেলো। সেখানে পরিচয় হলো স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক নুরুল হকের সাথে। তিনিই আমার দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। খাবার শেষে আবার হাঁটা শুরু করলাম। এখন একা নয়; সাথে নুরুল হকও । তিনি কালনা ফেরীঘাট পর্যন্ত যাবেন আমার সাথে। গল্প করতে করতে চলে এলাম কালনা ফেরীঘাট। এখানে বসে আমরা চা-বিস্কুট খেলাম। তারপর ফেরীতে উঠি। নুরুল হকও আবার লক্ষ্মীপাশা ফিরে গেলেন। আমি এখন নবগঙ্গা নদীর উপর ভাসছি। নবগঙ্গা নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা এবং নড়াইল জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ২১৪ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৮৫ মিটার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা ‘পাউবো’ কর্তৃক নবগঙ্গা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৪৫। এটি মাথাভাঙ্গা নদীর শাখা। মাথাভাঙা থেকে ‘গঙ্গা নবরূপপ্রাপ্ত হয়েছে’- এ কারণেই এর নামকরণ হয়েছে নবগঙ্গা।

ফেরী ঘাটে পৌঁছলো। সবাই নেমে যাচ্ছে। আমিও নামছি। এমন সময় দুজন ভদ্রলোক আমাকে ডেকে ঘাটের এক পাশে নিলেন। তারা দুজনেই আমাকে প্রশ্ন করছেন। আমি উত্তর দেওয়ার সুযোগই পাচ্ছি না। আমি নিজেই বললাম, আপনার একটু থামুন। আমি নিজেই বলছি আমার পরিচয়। তারপর সবকিছু খুলে বললাম। তখন তারা তাদের পরিচয়ও দিলেন। তারা পুলিশ। সাদা পোশাকে ডিউটি করছেন। তারা খুবই উৎসাহিত হলেন। আমাকে নিয়ে একটি হোটেলে ঢুকলেন। সেখানে দই-মিষ্টি খাওয়ালেন। এমন সময় গোপালগঞ্জের ডেইলি স্টার পত্রিকার জেলা প্রতিনিধির ফোন এলো। তিনি ফোনে জানালেন, আমার জন্য ভাটিয়াপাড়া চৌরাস্তা অপেক্ষা করছেন। গোপালগঞ্জ আমার থাকার ব্যবস্থা তিনিই করেছেন। রাতেই তার সাথে কথা হয়েছিলো। ভাটিয়াপাড়া মোড়ে এসে তার সাথে দেখা হলো। তার সাথে যুগান্তর পত্রিকার প্রতিনিধিও এসেছেন। তারাও এখন আমার সাথে হাঁটছেন। কিছুদূর হাঁটার পর জানালেন, আমাদের কাশিয়ানী ডাকবাংলো যেতে মেইন রাস্তা থেকে ভেতরে ঢুকতে হবে। বোয়ালমারী-ভাটিয়াপাড়া সড়ক ধরে যেতে হবে। তারা আমাকে জানালেন, এখন যেহেতু আমরা ভেতরের দিকে যাবো; সেহেতু আমরা একটি ভ্যানে যেতে পারি। এটা তো তোমার হিসেবের বাইরে। এখনো প্রায় দুই-আড়াই কি.মি রাস্তা বাকি। আমি ভ্যানে যেতে রাজি হলাম না। আমার একটাই কথা, হাঁটতে এসেছি। এখানে এই একটু জায়গা ভ্যানে উঠবো না। আপনারা ভ্যানে গিয়ে অপেক্ষা করেন। আমি হেঁটেই আসছি।

ডাকবাংলোতে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আমার আগেই তারা ভ্যানে চলে এসেছিলেন। আমার সাথে বেশ কিছু সময় থেকে তারা চলে গেলেন। রাতের খাবারের ব্যবস্থা তারাই করে গেছেন। দু’দিন ধরে গোসল করা হয়নি। তাই আজ ঠান্ডা পানি দিয়েই গোসল করে ফেললাম। রাতের খাবারও কেয়ারটেকার রুমে এনে দিয়ে গেলেন। আগে কখনো সরকারি ডাকবাংলোতে থাকা হয়নি। এবারই প্রথম। যে কয়টা ডাকবাংলোতে থেকেছি; সবগুলোই আমার ধারণা পাল্টে দিয়েছে। এর কারণটা বলি- আগে শুনেছি সরকারি বাংলোগুলো নাকি ভাঙাচোড়া পুরনো থাকে। কিন্তু আমি যে ক’টার মধ্যে ছিলাম; সব ক’টাই পরিষ্কার চকচকে গোছানো ছিলো। মনে হচ্ছে- ভালো কোন হোটেলে আছি। খাবার শেষে শরীরটা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। তাই নতুন আরো একটি সুন্দর সকালের অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পড়লাম।

Advertisement

এসইউ/আরআইপি