জাতীয়

শিক্ষকদের আন্দোলন স্থগিত নিয়ে যা ঘটলো

আন্দোলনরত শিক্ষকদের অনশন ভাঙাতে সোমবার বিকেল ৫টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন সচিব আসিফ-উজ-জামান এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

Advertisement

শহীদ মিনার চত্বরে কিছুক্ষণ অবস্থান করে আন্দোলনরত শিক্ষকদের উদ্দেশ্য করে মাইক হাতে নিয়ে মন্ত্রী বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দাবি আদায় করা যায় না। বরং আলোচনার টেবিলে বসলে সমস্যার সমাধান হবে। বেতন বৈষম্যের বিষয়টি ইতিপূর্বেও আপনারা বলেছেন, তবে আজকের মতো করে বলেননি। আপনাদের নেতৃবৃন্দ দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরবেন ফোরামে। সেখানে যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারলে, সেখানে যদি ভূমিকা রাখি...।

মন্ত্রীর এ বক্তব্যের মধ্যেই উপস্থিত সাধারণ শিক্ষকরা বলতে থাকেন, ‘না, না। আমাদের দাবি মানতে হবে। মানি না, মানি না। আমাদের আন্দোলন চলবে।’

এ সময় মন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন শিক্ষক নেতা মাইক হাতে নিয়ে বলে উঠেন, আমাদের মন্ত্রী এখানে এসেছেন। মন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আমাদের দাবি যৌক্তিক হলে, অচিরেই পূরণ হবে।

Advertisement

এ পর্যায়েও সাধারণ শিক্ষকদের একটি অংশ আবার বলতে থাকেন ‘মানি না, মানবো না। তোমরা আমাদের এখানে তিন দিন ধরে বসিয়ে রেখছো। আমাদের দাবি মানতে হবে, আমাদের দাবি মানতে হবে। দালাল কয়টা গেছে আলোচনা করতে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা চাই।’

এরপর আবার মাইক নিজের হাতে তুলে নিয়ে মন্ত্রী বলেন, আপনাদের দাবি বাস্তবায়ন করতে হলে, আমরা দু’জন কিন্তু এটা পারব না। সরকারের যে যে অঙ্গগুলো এ গ্রেডেশন করে এবং সর্বশেষ যে বেতনক্রম নির্ধারণ করেছে, তাদের সঙ্গে বসতে হবে। তাদের সঙ্গে বসে আমাদের মন্ত্রণালয়ের যুক্তিটা আমরা তুলে ধরব। এরপর আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে। আপনাদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা হয়েছে, সেই কথার প্রেক্ষিতেই আমরা এখানে এসেছি। আপনাদের নেতৃবৃন্দ যদি কথা না দিতো, তাহলে আমরা এখানে আসতাম না।

মন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্যেই উপস্থিত শিক্ষকদের একটি অংশ বলতে থাকেন, আমরা বাড়ি যাবো না, শহীদ মিনারেই থাকবো। দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা চাই। দালালরা চলে যাও। মানি না, মানবো না।

এ পরিস্থিতিতে মাইক হাতে নেন আন্দোলনরত শিক্ষকদের নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্য থেকে নাসরিন সুলতানা। তিনি বলেন, ‘সংগ্রাম আপনারা ডাকেননি, আমি ডেকেছি। সুতরাং সিদ্ধান্ত আমার, আপনাদের মানতে হবে। মানতে হবে। একটা কথাও আপনারা বলবেন না। আমি যতক্ষণ বলবো শুধু শুনতে হবে। একটা কথাও কেউ বলবেন না। আমি আজকে এক মাস আপনাদের জন্য শ্রম দিয়েছি, মেধা দিয়েছি। আমি না খেয়ে আপনাদের জন্য কাজ করেছি।’

Advertisement

তিনি বলেন, আমি আপনাদের বাইরের কেউ না। আপনাদের সঙ্গে আমার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। আমার থেকে বঞ্চিত আপনারা কেউ না। আমার চাকরির বয়স ২৮ বছর। আমি এমএ পাশ করেছি, বিএড করেছি। তারপরও বঞ্চিত রয়েছি। আমার কষ্ট আপনাদের থেকে বেশি।

‘সুতরাং আমার কষ্ট যদি আপনাদের থেকে বেশি হয়, আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনাদের তা মানতে হবে। আমার সিদ্ধান্ত আপনাদের মঙ্গলের জন্য। সুতরাং আমার ওপরে কেউ কথা বলবেন না। আমার কর্তৃপক্ষ, আমার কাছে অত্যন্ত সম্মানের। কর্তৃপক্ষের সম্মান, আমাদের সম্মান। কোনো কথা বলবেন না, একদম না’ বললেন নাসারিন।

তিনি বলেন, আমরা আন্দোলন ঘোষণা করেছি। আন্দোলন চালিয়ে আসছি। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, আমরা একটা সিদ্ধান্তে এসেছি। এ সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। অর্থাৎ এ সিদ্ধান্তই আমাদের চূড়ান্ত হওয়া উচিত। কিন্তু আমি আন্দোলন প্রত্যাহার করিনি, আন্দোলন স্থগিত করেছি। কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের সমস্যার সমাধান না করেন, আমরা আবার চলে আসবো। সুতরাং আপনারা আমাদেরকে সেই পর্যন্ত সময় দিবেন। আমাদের কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে এসেছেন, তাদের কাছ থেকে অনশন ভঙ্গ করে যার যার মতো ফিরে যাব।

এ পর্যায়ে আবার বিক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন সাধারণ শিক্ষকরা। এ সময় নাসরিন সুলতানা বলেন, আমরা ১০টি শিক্ষক সংগঠন আছি। আপনারা যদি আমাদের কথা না শুনেন, আমরা পদত্যাগ করব। তখন যদি দাবি পূরণ না হয়, দায়ভার কে নিবেন হাত তুলেন। কে দায়ভার নিবেন হাত তুলেন, আসেন ওপরে, দায়িত্ব নেন।

কিন্তু এ সময় উপস্থিতদের মধ্য থেকে কেউ হাত তুলে দায়িত্ব নেয়ার বিষয়ে সম্মতি দেখাননি। সেই সঙ্গে যারা দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্তর প্রতিবাদ করছিলেন, তারা একে একে বসে পড়েন। তখন নাসরিন সুলতানাসহ কয়েকজন শিক্ষক নেতাকে জুস খাইয়ে অনশন ভাঙান প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী। এরপর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ত্যাগ করেন মন্ত্রী।

মন্ত্রী চলে যাওয়ার পর আবার বিক্ষোভ করতে থাকেন শিক্ষকদের একটি অংশ। সেই সঙ্গে তারা ঘোষণা দিতে থাকেন শহীদ মিনারে আন্দোলন চলবে। এক পর্যায়ে কয়েকজন শিক্ষক নাসরিন সুলতানাকে ঘিরে ধরেন। তখন কয়েকজন সাংবাদিক উপস্থিত হলে নাসরিন সুলতানা বলেন, আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করিনি। এক মাসের জন্য স্থগিত করেছি।

নাসরিন সুলতানার এ মন্তব্যের পর কয়েকজন শিক্ষক তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, আপা আপনি এসে মাইকে ঘোষণা দেন আমরা কি করব। এখানে থাকবো না, চলে যাবে। উত্তরে নাসরিন বলতে থাকেন আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দেন। আমি জোট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আপনাদের সঙ্গে কথা বলবো।

এক পর্যায়ে সন্ধ্যা ৬টার দিকে কয়েকজন হাতে বাঁশি নিয়ে শহীদ মিনারে উপস্থিত হন। বাঁশি বাজিয়ে তারা শহীদ মিনারের বেদি থেকে শিক্ষকদের নিচে নামিয়ে দেন। এক পর্যায়ে তাদের নির্দেশে শহীদ মিনার থেকে মাইক খুলে নেয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে শহীদ মিনারে কয়েকজন ঝাঁড়ু হাতে উপস্থিত হন। বাঁশি হাতে নিয়ে একদল শিক্ষকদের শহীদ মিনার চত্বর থেকে নামাতে থাকেন। আর এক দাল হাতে ঝাঁড়ু নিয়ে শহীদ মিনার চত্বর পরিষ্কার করতে থাকেন।

এ পরিস্থিতিতে দেখতে দেখতে শহীন মিনার প্রাঙ্গণ প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যেই শহীদ মিনারে অবস্থান নেয়া শিক্ষকদের ৯০ শতাংশ স্থান ত্যাগ করেন।

এমএএস/জেএইচ/আইআই