‘আমিনুল ইসলাম বুলবুল’। শুধু কি একটি নাম ? এক ইতিহাস? নাহ, তা কি করে হয় ? বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে এ নাম যে লতায় পাতায় জড়িয়ে আছে। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের যখন স্বর্ণ সময়, তখনকার তিন শীর্ষ ও জনপ্রিয়তম তারকার (অপর দুজন হলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ও আকরাম খান) অন্যতম আমিনুল ইসলাম।
Advertisement
যে আসরের প্রাচীর টপকে বাংলাদেশ ঢুকেছে আন্তর্জাতিক তথা বিশ্ব ক্রিকেটের মঞ্চে, ১৯৯৭ সালের সেই আইসিসি ট্রফি বিজয়ের অন্যতম রুপকার বুলবুল। এখন যে বিশ্ব আসরে টাইগাররা সেরা আটে পৌঁছে যায়, ১৯৯৯ সালে সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ প্রথম অংশ নিয়েছিল তারই নেতৃত্বে। সেটাই শেষ নয়। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ানও তিনি।
আজকাল তামিম, মুশফিক আর সাকিবরা প্রায় নিয়মিতই টেস্টে শতরান করছেন। কিন্তু ২০০০ সালের নভেম্বরে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের শতরান ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট বাগানের প্রথম ফুল।
যে দল টেস্টে মাঠে নামার আগে কখনো পাঁচদিনের ম্যাচই খেলেনি, সেই বাংলাদেশের একজন টেস্টে শতরান করতে পারে, তাও ভারতের মত পরাক্রমশালি দলের বিপক্ষে- তা যে ছিল কল্পনার অতীত। আমিনুল সেটাই করে দেখিয়েছিলেন। আমিনুল দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশিরাও টেস্টে তিন অংকে পা রাখতে পারে।
Advertisement
একটা দেশের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি-ভাববেন না গন্ডায় গন্ডায় আছে। টেস্ট ক্রিকেটের ১৪০ বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাসে মাত্র তিনজন ব্যাটসম্যানের আছে এ দূর্লভ কৃতিত্ব। তার একজন বাংলাদেশের ‘বুলবুল।’ তাইতো যে ব্যাট দিয়ে ওই ঐতিহাসিক সেঞ্চুরি করেছিলেন বুলবুল, তার জায়গা হয়েছে ক্রিকেট তীর্থ ‘লডর্সের’ মিউজিয়ামে।
পুরোনো ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা নম্র, বিনয়ী এ ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ মানুষটি মনে প্রাণে চান দেশের ক্রিকেটের সাথে জড়িয়ে থাকতে। কিন্তু হায়, সে সুযোগ তার আর হচ্ছে না। বুলবুলের সমবয়সী , সমসাময়িক, বন্ধু আর সহযোগি ক্রিকেটারদের প্রায় সবাই দেশে। অনেকেই বোর্ডে। কেউ কেউ নির্বাচক, কেউবা সহযোগি কোচ।
জাতীয় দলের সবচেয়ে কাছের বন্ধু আকরাম খান বোর্ড পরিচালক। জাতীয় দল পরিচালনা ও পরিচর্যার মূল দায়িত্বটিও আকরামের উপর। যাদের সাথে যুব দলে খেলে জাতীয় দলে ঢোকা, তাদের অন্যতম খালেদ মাহমুদ সুজনও বোর্ডের অন্যতম নীতি নির্ধারক। ১৯৮৭-৮৮ সালে বাংলাদেশে হওয়া বেক্সিমকো যুব (অনূর্ধ্ব-১৯) এশিয়া কাপে একসাথে খেলা হাবিবুল বাশার অন্যতম নির্বাচক। ক্লাব ও জাতীয় দলের দীর্ঘ দিনের সাথী মিনহাজুল আবেদিন নান্নু প্রধান নির্বাচক। তার সঙ্গে জাতীয় দলে খেলা নাইমুর রহমান দুর্জয়ও বোর্ড পরিচালক। বুলবুলের আরেক কাছের মানুষ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদও ছিলেন প্রধান নির্বাচক। নিজ থেকে সরে না দাঁড়ালে হয়তো এখনো ওই পদে থাকতেন ফারুক।
কিন্তু বুলবুল কোথাও নেই। পড়ে আছেন দেশের বাইরে। কাজ করছেন বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসিতে। বর্তমানে এশিয়ার ক্রিকেটের ডেভোলপমেন্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব আগলাচ্ছেন বুলবুল। কাজ করছেন বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসিতে। বর্তমানে এশিয়ার ক্রিকেটের ডেভোলপমেন্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব আগলাচ্ছেন বুলবুল।
Advertisement
ক্রিকেটার ও অধিনায়ক হিসেবে দেশের ক্রিকেটের জন্য সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে দেয়া এ ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ মানুষটি সে অর্থে প্রাপ্য সন্মান পাননি। এমনকি ঘটা করে অবসরের সুযোগটাও মেলেনি। তাই অবসরের ঘোষণা না দিয়ে বেশ কয়েক বছর আগেই মনের দুঃখে ও অভিমানে পাড়ি জমিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। এখনো তার পরিবার অস্ট্রেলিয়াতেই।
আইসিসির উচ্চ পদে আসীন, বেতন ও আনুষাঙ্গিক সুযোগ সুবিধাও বেশ। কিন্তু বুলবুলের মন পড়ে থাকে দেশে। বড় ইচ্ছে জাতীয় দলের সাথে কাজ করার। বহুবার ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন, ‘আমার একটাই ইচ্ছে জাতীয় দলের সাথে কাজ করা।'
সেটা কিভাবে? বুলবুলের আক্ষেপ জড়ানো জবাব, 'আগে তো অফার আসুক। প্রস্তাব পেলেই না বলতে পারবো, কোথায় কোন পদে কাজ করবো। কাজের ধরনটাই বা কি হবে। এসব তো আলাপ অলোচনার প্রেক্ষিতে ঠিক হতে পারে।’
দুঃখজনক হলেও সত্য, বুলবুলকে বোর্ড থেকে কোনোরকম অফারই করা হয়নি। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে চলে যাবার পর বিসিবি হন্নে হয়ে একজন হাই প্রোফাইল বিদেশি কোচ খুঁজে বেড়াচ্ছে। হাতের কাছেই বুলবুল। কিন্তু তার দিকে নজর নেই।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বড্ড বিদেশি নির্ভর মানসিকতায় এগুচ্ছে। তাইতো কোচিংয়ে হাত পাকিয়ে ফেলার পরও বুলবুলের ডাক পড়েনি। আইসিসির গ্রেডিংয়ে তার ধারে কাছে নেই-সেই কালপাগে, সামারাবিরাসহ আরও কয়েকজন বিভিন্ন সময় এসে স্পেশালিষ্ট কোচের দায়িত্ব পালন করে হাজার হাজার ডলার নিয়ে চলে গেছেন। কিন্তু ঘরের ছেলে বুলবুলের ডাক পড়েনি।
হেড কোচ তো বহুদূরে, ব্যাটিং কোচ হিসেবেও বুলবুলের প্রতি এতটুকু আগ্রহ দেখায়নি বিসিবি।
প্রশ্ন হলো, যিনি আইসিসির ডেভোলপমেন্ট ম্যানেজারের পাশাপাশি কোচিংয়ের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ফেলেছেন, আধুনিক ক্রিকেট দর্শনটা যার জানা, তাকে সুযোগ দিয়ে দেখলে কি হয়? মাঝে ব্যাটিং কোচ হিসেবে কাজ করা থিলান সামারবিরা দেড় বছর কাজ করে প্রতিটি কর্মদিবসে ৫০০ মার্কিন ডলার করে বাগিয়ে নিয়ে গেছেন। অথচ কোনো প্রাপ্তি নেই। তার কোচিংয়ে কোনো ব্যাটসম্যানের এতটুকু উন্নতি হয়নি। বরং সৌম্য সরকার আর লিটন দাসের ব্যাটে ধারাবাহিকতা হারিয়েছে। তারা এখন ভাল খেলতে পারেন না, সাব্বিরের ব্যাটের ধারও গেছে কমে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি করে গেছেন সামারাবিরা? অনেকেরই ধারণা ও বিশ্বাস , সামাবিরার চেয়ে বুলবুল অনেক ভাল কাজ করতেন। প্রশ্ন হলো, বিসিবি তার দিকে নজর দেবে কবে? কবে ঘরের ছেলে বুলবুল তার মেধা, মনন ও প্রজ্ঞার প্রকৃত কদর পাবেন?
আকরাম খান, নাইমুর রহমান দুর্জয় আর খালেদ মাহমুদরা যদি বোর্ডের অন্যতম নীতি নির্ধারক হতে পারেন; মিনহাজুল আবেদিন নান্নু আর হাবিবুল বাশার যদি নির্বাচক হিসেবে ভাল কাজ করতে পারেন, তাহলে বুলবুল কি অন্তত ব্যাটিং কোচ হতে পারেন না? দেশের ক্রিকেটের কাছে কি এটুকু দাবি তার নেই?
অযোগ্য হলে কথা ছিল। কেউ আমিনুল ইসলাম বুলবুলের মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না। সবাই বলছেন, কোচ হিসেবে বুলবুল নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। তার কোচিং দর্শনটাও খুব ভালো। এমনকি বাংলাদেশের সফলতম সেনাপতি মাশরাফি বিন মুর্তজাও মনে করেন, বুলবুল বর্তমান সময়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে অন্যতম সেরা বিকল্প।
আসলে ভিনদেশিদের দিয়ে দল পরিচালনা এখন একটা বাতিক হয়ে গেছে। ধারণা জন্মেছে, স্থানীয় কোচরা জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তাই যদি হবে, তাহলে খালেদ মাহমুদ সুজন বা সালাউদ্দীনরা বিপিএলে দেশি-বিদেশি তারকাদের কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন?
আসলে সময় এসেছে বুলবুল, সুজন আর সালাউদ্দীনদের মতো স্বদেশি কোচদের কাঁধে দায়িত্ব দেয়ার।
এআরবি/এমএমআর/এমএস