ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের এক নার্সিং সুপারভাইজারের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও চিকিৎসক নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে তিনি সাধারণ একজন সহকারী স্টাফ নার্স থাকলেও কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র স্টাফ নার্স ও পরবর্তীতে নার্সিং সুপারভাইজার (চলতি দায়িত্বে) পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদ (স্বানাপ) গঠন করে সদস্যসচিব হয়েছেন। ভাড়াটে উঠিয়ে দিয়ে কম ভাড়ায় নার্সেস কল্যাণ ক্যান্টিন চালাচ্ছেন। ঢামেকের নার্সদের হাসপাতালে ভালো পোস্টিং দেয়ার নামে মাসোহারাও আদায় করছেন।অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নার্স নেতা পরিচয়ে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন নার্সিং পরিদফতরে। ঢামেকে চাকরি করলেও সারাদেশের নার্সদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য তদবির করে লাখ লাখ টাকা আয় করেছেন। গুঞ্জন রয়েছে তিনি বর্তমানে ঢাকা শহরে দু`টি ফ্ল্যাটের মালিক। কিছুদিন আগে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে জাকজমকপূর্ণভাবে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।আলোচিত এই নার্স নেতার নাম আনিসুর রহমান। সাধারণ নার্সদের অভিযোগ আনিসুর রহমানের উত্থান অনেকটা রূপকথার মতো। কয়েক বছরের ব্যবধানে সাধারণ নার্স থেকে লাখ লাখ টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। তারা আনিসের বর্তমান অবস্থানকে আরেক নার্স নেতা শাহজাহান হাওলাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তারা বলেছেন, বর্তমান সরকারের শাসনামলের শুরুর দিকে শাহজাহান হাওলাদার নামে এক নার্স নেতা নার্সিং সেক্টরে নানা আর্থিক অনিয়ম করে আলোচিত হয়েছিলেন। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।সাধারণ নার্সরা আরো বলেছেন, আনিসুর রহমান ও তার সহযোগীরা হাসপাতালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে শোডাউন করে থাকেন। তার কারণে ক্ষমতাসীন সরকারের বদনাম হচ্ছে।কে এই আনিস :নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢামেক হাসপাতালের একাধিক নার্স জাগো নিউজকে জানান, বর্তমান সরকারের শাসনামলের শুরুতে আনিসুর রহমান সহকারী স্টাফ নার্স ছিলেন। ওই সময় তিনি সহকারী নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তৃতীয় শ্রেণি সরকারি কর্মচার কল্যাণ পরিষদে ঢামেক শাখার সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ ডিপ্লোমা নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ওইসব পদের কোনোটিতেই নেই। নতুন করে স্বাধীনতা নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে সদস্য সচিব হয়েছেন। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের প্রথম দিকে তিনি ঢামেক হাসপাতালের সহকারী নার্স ছিলেন। বিশেষ বিবেচনায় সহকারী নার্স থেকে তিনিসহ অন্যান্যরা সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে পদোন্নতি পান।তিন বছর না হতেই তিনি অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নার্সিং সুপারভাইজার (চলতি দায়িত্ব) পদ ভাগিয়ে নেন। প্রচলিত নিয়মানুসারে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে পাঁচ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকলে এ পদে নিয়োগ দেয়ার নিয়ম নেই।অভিযোগ রয়েছে তিনি বিভিন্ন সময় নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ সেলিম, বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক বদিউজ্জামান ভুইয়া ডাবলা, স্বাচিপ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানকে কাছের লোক পরিচয় দেন।তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:বর্তমান সরকারের শুরু থেকে বিভিন্ন সময় সুবিধা মতো মন্ত্রী, সচিব, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাংসদের নাম ভাঙ্গিয়ে নার্সদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানোর নামে গোপন চুক্তির মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। ঢাকা শহরে দু`টি ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাধারণ নার্সরা জাগো নিউজকে জানান, ঢামেক হাসপাতালের ওটি, সার্জারি, নিউরো সার্জারি, অর্থোপেডিকস, ইউরোলজি, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ), জরুরি বিভাগসহ বেশ কিছু বিভাগে রোগীদের সেবা দেয়ার মাধ্যমে ভালো অংকের টাকা রোজগার করা সম্ভব। নিয়মানুসারে এ সব বিভাগের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ইনচার্জদের দুই বছর পর পর বদলির কথা। কিন্তু আনিসুর রহমান ওয়ার্ড ইনচার্জদের কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে বছরের পর বছর একই ইনচার্জ দিয়ে কাজ চালাচ্ছেন।তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের কল্যাণে পরিচালিত একটি ক্যান্টিন মাসিক ৩০ হাজার টাকা ভাড়ায় নিজে চালাচ্ছেন। সাধারণ কর্মচারীরা জানান, এ ক্যান্টিন বাইরের লোকের কাছে মাসিক ৫০ হাজার টাকা অনায়াসে ভাড়া দেয়া সম্ভব।অভিযোগ রয়েছে, আনিসুর রহমান বিভিন্ন সময় নানা অনুষ্ঠানের নামে নার্সদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন। ঘটা করে অনুষ্ঠান করে হাসপাতালের পরিচালকসহ অন্যান্যদের কাছে নিজের ক্ষমতার শোডাউন করেন। তার এ কাজে সহযোগিতা করেন নার্স শিরিন আখতার, হারুনুর রশীদ দিপু, খাদিজা আক্তার, শেখ নিজামউদ্দিন প্রমুখ।মাস ছয়েক আগে সেবাতত্ত্বাবধায়ক জাহানারা বেগম এলপিআরে যাওয়ার আগে তার বিদায় অনুষ্ঠানের নামে ঢামেকে আট শতাধিক নার্সের কাছ থেকে জনপ্রতি ৮শ’ টাকা আদায় করেন। অভিযোগ রয়েছে ওই অনুষ্ঠান না করেই তিনি টাকা নিজে খরচ করে ফেলেছেন।সম্প্রতি স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের ব্যানারে ইফতার অনুষ্ঠান করার নামে বিভিন্ন ওয়ার্ড ইনচার্জকে প্রতি নার্সের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫শ’ টাকা থেকে এক হাজার টাকা আদায়ের নির্দেশ দেন। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও সাংসদ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনসহ অন্যান্যরা উপস্থিত থাকবেন বলে জানানো হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে তিনি ইফতার অনুষ্ঠান স্থগিত করেন।সব অভিযোগ অস্বীকার করলেন আনিস : জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক শনিবার বিকেলে সব অভিযোগের ব্যাপারে আনিসুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নার্সদের একটি গ্রুপ তার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে।তিনি কোনো মন্ত্রী, সাংসদ, রাজনৈতিক ও চিকিৎসক নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে নিয়ম, বদলি, পদোন্নতি ও বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা পয়সা নেননি বলে জানান।নার্সিং সুপারভাইজার পদে তিনি নিজ (চলতি দায়িত্ব) পালন করছেন। যে কেউ এ দায়িত্ব পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে পাঁচ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা অত্যাবশ্যক নয়।ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাটের মালিকানা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি হেসে বলেন, এটি ডাহা মিথ্যা অভিযোগ। তবে ক্যান্টিনটি তিনি মাসিক ৩০ হাজার টাকায় চালাচ্ছেন বলে স্বীকার করে বলেন, এ ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লিখিত চুক্তি রয়েছে।বিভিন্ন ওয়ার্ড ইনচার্জ থেকে তিনি কোনো মাসোহারা নেন না বলে দাবি করেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোনো চাঁদা তোলেন না জানিয়ে তিনি বলেন, কর্মচারীরা স্বেচ্ছায় চাঁদা দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকে।এমইউ/বিএ/আরআই
Advertisement