দেশজুড়ে

হেঁটে চলা মানুষগুলোকে ডেকে গাড়িতে তুলতেন তিনি

ষাটোর্ধ্ব মফিজল হক বলছিলেন, আমাদের মিয়া ভাই আর বাজারে আসবে না। একসঙ্গে বসে চা খাবে না। বাড়িতে যাওয়া-আসার পথে কাউকে ডেকে আর গাড়িতেও তুলবে না। বলবে না চলো একসঙ্গে যাই। আমরা যে আজ একা হয়ে গেলাম। তার কথা শেষ না হতেই পঞ্চাশর্ধ্ব সুলতান উদ্দিন বলে উঠলেন, ছোটবেলা থেকেই ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। সাংসদ হলেও তার মনে ছিল না কোনো অহঙ্কার। আগে যেমন ছিলেন, সাংসদ হওয়ার পরও ঠিক তেমনই ছিলেন তিনি।

Advertisement

তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সত্তোরোর্ধ্ব জয়নাল আবেদীন বললেন, ছোটবেলা থেকেই ভালো ব্যবহারের জন্য সবার কাছেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ছিলেন সবার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। আর তাই তার মৃত্যুতে পুরো উপজেলাজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তিনি ছিলেন সুন্দরগঞ্জবাসীর প্রিয় নেতা। তার এ অভাব কখনো পূরণ হবে না।

এরকম আরও অনেক কথা হচ্ছিল গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের পাঁচপীর বাজারের দোকানগুলোতে। আর যাকে নিয়ে এসব কথা হচ্ছিল তিনি হচ্ছেন গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা আহমেদ। একজন ভালো মানুষ হিসেবে যার সুপরিচিতি রয়েছে পুরো উপজেলাজুড়েই।

উপজেলার সুন্দরগঞ্জ পৌরসভাসহ শ্রীপুর, কঞ্চিবাড়ী, শান্তিরাম, সর্বানন্দ, বামনডাঙ্গাসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে সাংসদকে একনজর দেখতে আসা মানুষরা দুপুর থেকেই পাঁচপীর বাজারে সাংসদকে নিয়ে মত্ত ছিলেন গল্পে। দোকানে চায়ের কাপে আর মানুষের মুখে-মুখে ছিল সাংসদ গোলাম মোস্তফাকে নিয়ে আলোচনা। অনেকে আলোচনার মধ্যে ডুকরে কেঁদেও ওঠেন। কথা বলার সময় অনেকের চোখে জল ছলছল করছিল।

Advertisement

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের ফারাজিপাড়া গ্রামে সাংসদ গোলাম মোস্তফা আহমেদের বাড়ি। গাইবান্ধা থেকে সড়কপথে একঘণ্টা যাওয়ার পর মঙ্গলবার দুপুর দেড়টায় পাঁচপীর বাজারে পৌঁছে দেখা যায়, শ্রীপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর বাজার থেকে রিকশা-ভ্যান, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে মানুষ যাচ্ছেন পাঁচপীর বাজারের দিকে। আশপাশের বিভিন্ন সড়ক ধরে দলে দলে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছেন চন্ডিপুর ডাকবাংলো সংলগ্ন ফুটবল খেলার মাঠে। সবার চোখে-মুখে দুঃখের ছাপ। এখানে মাঠ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। গর্তগুলো মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। নেতাকর্মী ও সরকারি কর্মকর্তারা মাঠ তদারকির কাজ করছেন।

এখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পূর্বে সাংসদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মানুষ দল বেঁধে যাচ্ছেন সাংসদের বাড়ির দিকে। বাড়ির সামনের উঠোনে কবর তৈরি করছেন কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ লোক। তাদেরকে ঘিরে আশেপাশে অনেক মানুষের জটলা। সাংসদের পাকাবাড়িতে ইতোমধ্যে আত্মীয়-স্বজনরা আসতে শুরু করেছেন। বাড়ির ভেতরে স্বজনরা কান্না-কাটি করছেন।

এখানে সাংসদ গোলাম মোস্তফা আহমেদের বড় ভাইয়ের ছেলে গোলাম ফারুক মান্নু বললেন, সুন্দরগঞ্জের সাংসদ হিসেবে জয়লাভের পর অল্পদিনের মধ্যেই আমার চাচা গোলাম মোস্তফা সুন্দরগঞ্জের মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। তার মতো একজন নেতাকে হারানো মানে একজন ভালো অভিভাবককে হারালো সুন্দরগঞ্জবাসী। আমাদের শুধু এখন একটিই চাওয়া যে দুর্ঘটনার কারণে আমার চাচা সাংসদ গোলাম মোস্তফা আহমেদ মারা গেলেন সেই সড়ক দুর্ঘটনার তদন্ত করা হোক।

মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা থেকে রাত সাড়ে সাতটা পর্যন্ত পাঁচপীর বাজারে আসা মানুষ ও স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একজন সাধারণ মানুষ থেকে কেউ অসাধারণ হলে তার মধ্যে অনেক পার্থক্য পাওয়া যায়। আগের মানুষ আর বর্তমান মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় অনেক পরিবর্তন। কিন্তু গোলাম মোস্তফা আহমেদ সাংসদ হওয়ার পরও তার কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি আগে যেমন মানুষের সঙ্গে মিশতেন, সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পরও ঠিক আগের মতোনই মিশেছেন মানুষের সঙ্গে। মিশে থাকার তার এ অসম্ভব গুনাবলিই তিনি খুব অল্প সময়েই মানুষের মনে জায়গা করে নেন।

Advertisement

সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করতেন সাংসদ গোলাম মোস্তফা আহমেদ। আর তিনি ছিলেন সহজ-সরল বোধসম্পন্ন একজন মানুষ। সাংসদের কথা উঠলেই মানুষ বলতেন, খুব ভালো একজন মানুষ ছিলেন গোলাম মোস্তফা আহমেদ। তিন দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা এ মানুষটি সবসময় কাজ করেছেন মানুষের জন্য। তাই জনমানুষের নেতা হিসেবে যুগ-যুগ ধরে সাংসদ গোলাম মোস্তফা আহমেদ মানুষের মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকবেন বলেই মনে করেন সুন্দরগঞ্জের মানুষ।

রওশন আলম পাপুল/এমএএস/এমএস