দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকের বই থেকে হুবহু লেখা চুরি করে তৈরি করা প্রবন্ধ জমা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হতে যাচ্ছেন আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু বকর সিদ্দিক।অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ‘কায়ফিয়্যাহ কিতাবাহ আল-বাহাছ আল-আদাবি : দিরাসাহ তাহলিলিয়্যাহ’ শীর্ষক ৩৮ পৃষ্ঠার প্রবন্ধের প্রতিটি লাইন তিনি কোনো না কোনো বই থেকে সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে গাড়ি ক্রয়ে দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, অর্থের বিনিময়ে পিএইচডি প্রদানসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, দলীয় বিবেচনায় এ ধরনের অভিযোগ উপেক্ষা করে গত ১০ জুন সিএনডি বৈঠকে ওই শিক্ষককে বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক করার প্রস্তাব করা হয়েছে।অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০৩ সালের ৯ জুন দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যারাবিক জার্নালে ড. আবু বকর সিদ্দিকের ‘কায়ফিয়্যাহ কিতাবাহ আল-বাহাছ আল-আদাবি : দিরাসাহ তাহলিলিয়্যাহ’ নামক ৩৮ পৃষ্ঠার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি আরবি সাহিত্যের স্বনামধন্য চারজন লেখকের চারটি বই থেকে হুবহু নকল করে প্রবন্ধটি রচনা করেন। চতুরতা প্রদর্শন করে দু’একটি শব্দ যোগ করলেও তাতে রয়েছে ব্যকরণগত ভুল।নকল করা চারটি বই হলো ড. আব্দুল মোনেম খাফাজীর লিখিত বই ‘কাইফা তাকতুবু বাহছান জামিইয়্যান’, ড. শওকী দায়ফের লিখিত গ্রন্থ ‘আল-বাহছ আল-আদবী’, ড. আব্দুস সালাম হারুনের প্রকাশিত গ্রন্থ ‘তাহকীক আন-নুসুস ওয়া নাশরুহা’ এবং ড. সালাহ উদ্দিন আল মুনাজ্জিদের প্রকাশিত গ্রন্থ ‘কাওয়ায়িদ তাহকীক আল-মাখতুতাত’।অনুসন্ধানে দেখা যায়, তিনি একটি প্যারা বা অংশ চারটি বইয়ের এক একটি অংশ থেকে নিয়েছেন। তিনি ৩৮ পৃষ্ঠা সম্বলিত প্রবন্ধ গ্রন্থটির ভূমিকা নিয়েছেন ড. আব্দুল মোনেম খাফাজীর লিখিত বই ‘কাইফা তাকতুবু বাহছান্ জামিইয়্যান’ নামক গ্রন্থের ৩ ও ৪ পৃষ্ঠা থেকে হুবুহু নকল করে। এর পরের অংশ নিয়েছেন ৯ ও ১০ নং পৃষ্ঠা থেকে। পরের প্যারা নিয়েছেন ড. শওকী দায়ফ এর লিখিত গ্রন্থ ‘আল-বাহছ্ আল-আদবী’ এর ৯ ও ১০ নং পৃষ্ঠা থেকে। পরবর্তী প্যারা নিয়েছেন খাফাজীর গ্রন্থের ১০ ও ১২ নং পৃষ্ঠার পৃথক অংশ থেকে। আবার দায়ফের ১৭ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে কিছু অংশ নিয়ে ফিরে গেছেন খাফাজীর গ্রন্থের ১৫ ও ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায়। এখান থেকে সামান্য অংশ নিয়ে আবার খাফাজীর গ্রন্থের ১৭, ১৮, ১৯ ও ২৮ পৃষ্ঠার খণ্ড খণ্ড অংশ নিয়ে সাঁজিয়েছেন নিজের প্রবন্ধ। এখান থেকে খণ্ড খণ্ড অংশ নিয়ে আবার একই বইয়ের ২৯ নম্বর পেইজের কিছু অংশ নিজের মতো করে লিখেছেন। এরপর আবার দায়ফের গ্রন্থের ১৩৯, ১৪২, ১৪৪, ১৪৫ পৃষ্ঠা থেকে খণ্ড খণ্ড অংশ নকল করেছেন। পরের অংশ খাফাজীর গ্রন্থের ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৪১, ৪২ এবং ৪৩ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে খণ্ড খণ্ড অংশ করে নকল করা। দায়ফের ২১৪ ও ২১৫ পৃষ্ঠার কিছু অংশ নিয়ে যোগ করেছেন খাফাজীর গ্রন্থের ৩৩ থেকে ৩৬, ৫৯ থেকে ৬১ পৃষ্ঠার খণ্ড খণ্ড অংশ। এরপর আবার ফিরে এসেছেন একই বইয়ের ৩৭, ৩৮, ১৩, ১৪, ৭৯ পৃষ্ঠার খণ্ড খণ্ড অংশে। এরপরের অংশ নিয়েছেন ড. আব্দুস সালাম হারুনের প্রকাশিত গ্রন্থ ‘তাহকীক আন্-নুসুস ওয়া নাশরুহা’ এর ৪২ পৃষ্ঠার খণ্ড খণ্ড অংশ। আবার ফিরে গেছেন একই বইয়ের ২৯ থেকে ৩৩ পৃষ্ঠার খণ্ড খণ্ড অংশে। এরপর ড. সালাহ উদ্দিন আল মুনাজ্জিদের প্রকাশিত গ্রন্থ ‘কাওয়ায়িদ তাহকীক আল-মাখতুতাত’ এর ১২ থেকে ১৪ পৃষ্ঠার খণ্ড খণ্ড অংশ নকল করেন। এরপর ড. হারুনের গ্রন্থের ৪০ থেকে ৪১ পৃষ্ঠার খণ্ড খণ্ড নিয়ে আবার ফিরে গেছেন মুনজ্জিদের গ্রন্থের ১৫ থেকে ১৭ পৃষ্ঠার খণ্ড খণ্ড অংশে। এরপর নকল করছেন একই বইয়ের ১৯ থেকে ৩১ পৃষ্ঠার খণ্ড খণ্ড অংশ নকলের মাধ্যমে শেষ করেছেন নিজের লিখিত ‘কায়ফিয়্যাহ কিতাবাহ্ আল-বাহাছ আল-আদাবি: দিরাসাহ্ তাহলীলিয়্যাহ্’ নামক ৩৮ পৃষ্ঠার গবেষণা প্রবন্ধ।অভিযোগ রয়েছে ড. সিদ্দিকের প্রায় সকল গবেষণা প্রবন্ধই অন্যের লেখা থেকে চুরি করা। তার লেখায় সাধারণত নিজস্ব কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না।এছাড়াও, ড. আবু বকর সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে নিজ বিভাগের মাস্টার্সের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ আনেন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে ১৫ জানুয়ারি নির্ধারিত পরীক্ষা স্থগিত করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে তদন্ত কমিটির দেয়া রিপোর্টে আবু বকরকে অভিযুক্ত ঘোষণা করা হয়। ড. আবু বকর সিদ্দিকের বিরুদ্ধে আরো রয়েছে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে বোর্ডের জন্য গাড়ি ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ। শুধু তাই নয় পুরাতন গাড়ি বিক্রি করে নিজের পকেটে টাকা জমা করেছেন বলেও অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। সেই সময় তিনি চুক্তিভিত্তিক চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেই তৎকালীন মাদ্রাসা বোর্ডের রেজিস্ট্রার তমিজউদ্দিনকে নিয়ে নতুন গাড়ি কিনতে যান। ১৬ লাখ টাকার গাড়ি ২৮ লাখ ২৫ হাজার টাকায় ক্রয় করেন। এমনকি পর্যাপ্ত ড্রাইভার থাকা সত্ত্বেও ঘুষের বিনিময়ে একজন ড্রাইভার নিয়োগ দেয়ারও অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয় নিজের ক্ষমতাবলে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে নিজস্ব এলাকার এক ব্যক্তিকে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবেও নিয়োগ দেন তিনি।গবেষণা জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত শিক্ষক জাগো নিউজের কাছে প্রবন্ধটি নিজের লেখা বলে স্বীকার করেন। কিন্তু চারটি বই থেকে হুবুহু নকলের বিষয়ে জানতে চাইলে এক পর্যায়ে নিজের লেখা বইটির কথাও ভুলে যান তিনি। তিনি বলেন, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। এমন কি কত সালে কোন জার্নালে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে তাও অবহিত নন তিনি। একপর্যায়ে কথা বলতে অপরাগতা জানিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক প্রতিবেদকের মুঠোফোনের সংযোগ কেটে দেন।গবেষণা জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষককে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগের ব্যপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক অবাক হয়ে জাগো নিউজকে বলেন, তাই না-কি! এমন অভিযোগ তো আমার কাছে আসেনি। অভিযোগ আসলে, এর সত্যতা যাচাই করে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’এমএইচ/এসকেডি/বিএ/এমএস
Advertisement