১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন সেতারা বেগম। তার সেবায় সুস্থ হয়ে রণাঙ্গনে ফিরে যেতেন মুক্তিযোদ্ধারা। শুধু তাই নয়, তার বাড়িতেও দেয়া হতো আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা। শত ভয় বাধা উপেক্ষা করে নির্ভীক চিত্তে নার্স হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সেবা দিয়েছেন সেতারা বেগম। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে গিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছিলেন তিনি। তবে সৌভাগ্যক্রমে রক্ষা পান তিনি। তারপরও দমে যাননি।
Advertisement
কখনও গুপ্তচরের কাজ করেছেন। আবার কখনও মাইলের পর মাইল হেঁটে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি রুটি। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন জায়গা থেকে লুট করা অস্ত্র লুকাতে নিয়ে আসতো তার কাছে। ঘরের কোণে মাটি খুড়ে সেই অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন সেতারা বেগম। বিপদের কথা জেনেও অসীম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন তিনি।
মায়ের এ সাহসিকতার কথাগুলো বলছিলেন সেতারা বেগমের ছোট মেয়ে মাহফুজা আক্তার রনি। তিনি বলেন, মায়ের বয়স হয়েছে। এখন অনেক কিছুই আগের মতো মনে করতে পারেন না। তবে তার মুক্তিযোদ্ধা মামা ও স্বজনদের কাছ থেকে মায়ের অনেক সাহসিকতার গল্প শুনেছেন। তখন মাকে নিয়ে গর্ব হয়েছে।
মেয়ে মাহফুজা আক্তার রনি কথাগুলো বলার সময় পাশেই বসা ছিলেন সেতারা বেগম। বয়স প্রায় ৭৭ বছর। বার্ধক্যের কারণে তার শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বেঁধেছে। চোখে এখন ঝাপসাও দেখেন।
Advertisement
সেতারা বেগমের জন্ম গৌরনদী উপজেলার সরিকলের মীরা বাড়িতে। বাবা লতিফুর রহমান ছিলেন মিলের টেকনিশিয়ান। মা হালিমা বেগম গৃহিণী। তবে ছোট বেলায় তার বেশির ভাগ সময় কেটেছে উজিরপুর উপজেলার ষোলক মামার বাড়িতে। মেট্রিক পরীক্ষায় খারাপ করায় পড়ালেখা আর এগোয়নি।
১৯৬৭ সালে নগরীর কালীবাড়ি রোড নার্সিং সেন্টারে ভর্তি হন তিনি। এক বছর মেয়াদী নার্সিং প্রশিক্ষণ কোর্স তিনি সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন। ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময় বাবুগঞ্জের মহসিন উদ্দিনের সঙ্গে সেতারা বেগমের বিয়ে হয়। মহসিন উদ্দিন ছিলেন বরিশাল জেলখানার এলএমএ চিকিৎসক।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের ঘটনা জানতে চাইলে ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলেন সেতারা বেগম। তিনি বলেন, বিয়ের পর তারা জেলাখানার কোয়ার্টারে থাকতেন। নার্সিংয়ে প্রশিক্ষণ থাকায় মাঝে মধ্যে চিকিৎসার কাজে স্বামীকে সাহায্য করতেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে খবর পেলেন তার ছোট ভাই মীর মাহবুব হোসেন, ছোট বোনের স্বামী সিকান্দার হাওলাদার, মামা শাহজাহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাড়ি ছেড়েছেন। তিনিও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। তবে বাধ সাজলেন তার স্বামী। এরই মধ্যে মামা শাহজাহান এসে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে গেলেন তালতলী ক্যাম্পে।
Advertisement
স্বামীকে না জানিয়ে বুদ্ধি করে জেলখানার ওষুধ ও চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়ে গিয়েছিলেন। এভাবে স্বামীকে না জানিয়ে চিকিৎসা দিতে বাসা থেকে আরও কয়েকবার গোপনে বের হন তিনি। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময় পাক হানাদার বাহিনী বরিশালে বর্বরতা ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে নিরাপত্তার জন্য জেলখানার কোয়ার্টার থেকে তাকে মামার বাড়ি ষোলকে রেখে আসেন তার স্বামী মহসিন উদ্দিন।
সেখানে নিয়মিত তার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ হতো। কয়েক দিন পর পর মুক্তি বাহিনীর লোক এসে এক বস্তা করে আটা দিয়ে যেত। তিনি সেই আটা দিয়ে রুটি বানিয়ে কাপড়ে পেঁচিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে আসতেন। আবার কখনও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হতো ক্যাম্পে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে গিয়ে বহুবার বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি।
বুদ্ধি খাটিয়ে তা থেকে বেঁচেও গেছেন। একবার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রুটি বানিয়ে ষোলক থেকে বাটাজোড় দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময় বাটাজোড় পুলিশ ফাঁড়ি ছিল মধু হাওলাদারের জমিতে। তিনি সম্পর্কে সেতারা বেগমের নানা। পুলিশ ফাঁড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পাক সেনাদের সন্দেহ হয়। তারা তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। উপয়ান্তর না দেখে মধু হাওলাদারের নাতি বলে পরিচয় দেন। এ সময় ফাঁড়ির বাঙালি হাবিলদার মোস্তাফার অনুরোধে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে রুটি নিয়ে সোজা চলে যান মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পে।
বিভিন্ন জায়গা থেকে লুট করা অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ে আসতো তার কাছে। ঘরের কোনে মাটি খুঁড়ে সেই অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন তিনি।
সেতারা বেগম বলেন, এসব কারণে স্থানীয় রাজাকারদের নজরে পড়ে যান তিনি। একদিন রাতে আকস্মিকভাবে ষোলকের বাড়িতে পাক সেনারা হানা দেয়। গাড়ির শব্দ পেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে পানের বরজে আশ্রয় নেন তিনি। ভোরে স্বজনরা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেন। এরপর নিরাপত্তার কথা ভেবে ষোলক থেকে বাবার বাড়ি গৌরনদীর সরিকলে চলে যান। সেপ্টেম্বরের দিকে পাকবাহিনী সরিকলে আক্রমণ করে। গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে আগুন দিয়ে জালিয়ে দেয়। সেই যাত্রাও পালিয়ে রক্ষা পান তিনি। ৮ ডিসেম্বর বরিশাল পাক হানাদার মুক্ত হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর সংসার গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সেতারা বেগম। মুক্তিযুদ্ধের আড়াই বছর পর তার প্রথম কন্যা সন্তান মোর্শেদা আক্তার বিজলীর জন্ম হয়। এর কয়েক বছর পর জন্ম হয় দ্বিতীয় কন্যা সন্তান মাহফুজা আক্তার রনির। সংসার জীবনে সুখের কমতি ছিল না সেতারা বেগমের। দুই কন্যা সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটছিল তাদের। কিন্তু হঠাৎ করে সব এলোমেলো হয়ে গেল।
১৯৯০ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সেতারা বেগমের স্বামী মহসিন উদ্দিনের মৃত্যু হয়। স্বামী মারা যাওয়ায় কিছুটা ভেঙে পড়েন তিনি। এরপর শুরু হয় সন্তানদের মানুষ করার লড়াই। স্বামীর চিকিৎসা চালাতে ভিটেবাড়ির জমিটুকুও বিক্রি করে দিতে হয়েছিলো। স্বামীর মৃত্যুর পর কোনো আর্থিক সঞ্চয় ছিল না তার। স্বাবলম্বী হতে হবে। অন্তত সন্তান আর নিজের খরচটুকু জোগাড় করতে হবে। সন্তানদের মানুষ করতে দিনমজুরির কাজ শুরু করেন। কিছু টাকা সঞ্চয় হলে বাজার থেকে শাড়ি কিনে তা ফেরী করে বিক্রি করতে লাগলেন।
জীবন সংগ্রামের চড়াই-উৎরাইয়ের এসব কথা বলতে বলতে সেতারা বেগমের চোখ ভিজে ওঠে। শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুছে তা আড়াল করার চেষ্টা করেন।
হার না-মানা মানসকিতা ও আর্থিক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে দুই কন্যা সন্তানকে পড়ালেখা শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। এখন থাকেন ছোট মেয়ে জামাইয়ের নগরীর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের রেইনট্রিতলা সড়ক সংলগ্ন বাড়িতে।
সেতারা বেগমের ছোট মেয়ে মাহফুজা আক্তার রনি বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর মা অনেক কষ্ট করেছেন। আমাদের মানুষ করতে দিনমজুরের কাজ করেছেন। অনেক কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি আনন্দ খুঁজে নিতেন। শেষ বয়সে এসে নানা জটিল রোগে ভুগছেন। তিন বার ব্রেইনস্ট্রোক হয়েছে। হৃদ রোগে ভুগছেন। তারপরও আল্লাহ তাকে বাচিয়ে রেখেছেন। কিন্ত অর্থের অভাবে চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে না। মাহফুজা আক্তার রনি আক্ষেপ করে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সেবা দিয়েছেন তার মা। অথচ আমার মায়ের এসব অবদানের কথা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। এখন তার খোঁজ নেয়ার কেউ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিলে তার ত্যাগ তিতিক্ষার প্রতি সম্মান দেখানো হতো।
বরিশাল সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হুমায়ুন কবির জানান, সেতারা বেগমের অবদানের বিষয়ে তার জানা নেই। ওই নামে কোনো নারী সুযোগ সুবিধা চেয়ে আবেদনও করেননি। তারপরও খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান ইউএনও।
সাইফ আমীন/এমএএস/এমএস