মানুষের চোখের রেটিনার আদলে আসছে কৃত্রিম রেটিনা বা প্রসেসর। কৃত্রিম রেটিনা বা প্রসেসর তৈরির জন্য কাজ করছেন ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চের (সিইআরএন বা সার্ন) একদল পদার্থবিজ্ঞানী। বর্তমানে বিদ্যমান যে কোনো প্রসেসরের চেয়ে ৪০০ গুণ দ্রুত কাজ করতে সক্ষম হবে এ প্রসেসর। খবর-বিবিসিইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ বা সার্ন সম্পর্কে কমবেশি সবারই ধারণা আছে। প্রথমত. এটা সেই ‘গহ্বর’, যেখানে বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তবে সেসময় মিডিয়ার কল্যাণে জনমনে ভীতি সঞ্চার হয়েছিল পাছে আবার পৃথিবীই না ধ্বংস হয়ে যায়। প্রায় ২৭ কিলোমিটার পরিধির একটা বৃত্তীয় গবেষণাকেন্দ্র সার্ন। মাটির নিচে এর গভীরতা ১০০ মিটার। এখন পর্যন্ত পদার্থবিদ্যা বিষয়ক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গবেষণা কেন্দ্র এটিই। অবশ্য চীন সম্প্রতি এর চেয়েও দ্বিগুণ বড় এক কণা-গবেষণা কেন্দ্র তৈরির ঘোষণা দিয়েছে।সার্ন সম্পর্কে অন্য যে তথ্যটা সবার জানা, তা হলো- এখানেই বিজ্ঞানীরা জন্ম দিয়েছিলেন ঈশ্বরকণার। এ কণার বিষয়ে ৫০ বছর আগেই কল্পনা করেছিলেন বলে ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন দুই বিজ্ঞানী। ইংরেজ বিজ্ঞানী পিটার হিগস এবং বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ফ্রাঁঁসোয়া এংলার্ট। এ সার্নেই আছে এলএইচসি নামের একটি যন্ত্র, যার পুরো নাম লার্জ হার্ডন কোলাইডার। যন্ত্রটির নামেই বোঝা যায়, সংঘর্ষ বাধানোই এর মূল কাজ। এলএইচসির মাধ্যমে সংঘর্ষ বাধানো হয় প্রোটন-প্রোটন কণায়। প্রোটন কণা খুবই সাধারণ, সহজলভ্য এক কণা। আমাদের পায়ের নিচের ধূলিকণায় কিংবা মহাকাশের গ্রহ-তারা সর্বত্রই প্রতিটি পদার্থেই প্রোটন কণার বসবাস।এলএইচসিতে প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষ বাধে মুখোমুখি। দুই দিক থেকে প্রোটন কণা ছুড়ে দেয়া হয়। প্রায় আলোর কাছাকাছি বেগে। ১ সেকেন্ডে এ রকম চার কোটি সংঘর্ষ বাধে এলএইচসির ভেতরে। প্রতিটা সংঘর্ষে জন্ম নেয় শত শত চার্জিত কণা। জন্মলগ্নেই কণাগুলো আবার মিলিয়ে যায়। এ অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই কণাগুলোর চেহারা-চরিত্র এবং জন্মের পর উধাও হওয়ার আগে কোন পথ ধরে তারা কী প্যাটার্নে ছুটে অদৃশ্য হয়ে যায়, তার সবই জানতে ব্রত থাকেন বিশ্বের সহস্র বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী। না, বিজ্ঞানীরা খালি চোখে এসব পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না। বিশেষ ধরনের প্রসেসরসমৃদ্ধ হাজারো কম্পিউটার সংঘর্ষের প্রতিরূপ বিশ্লেষণে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করে থাকে।মূলত এ রকমই বিশেষ কাজে ব্যবহারের জন্য মানুষের চোখের রেটিনার আদলে কৃত্রিম প্রসেসর বানানোর কথা ভাবছেন সার্নের পদার্থবিজ্ঞানীরা। আগের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রসেসরের চেয়ে এর কাজ করার গতি হবে ৪০০ গুণ বেশি। প্রোটনের সঙ্গে প্রোটনের সংঘর্ষে জন্ম নেয়া কণাগুলো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে কোন পথ ধরে ছুটে চলে, তা আরো দ্রুত ফ্রেমবন্দি করবে নতুন এ প্রসেসর।পদার্থবিজ্ঞানীরা এ প্রসেসর বানানোর অনুপ্রেরণা পেয়েছেন আমাদের চোখের রেটিনার কাছ থেকে। সোজা-বাঁকা, ত্রিভুজ-ষড়ভুজ, একেক ধরনের বস্তুকে চেনার জন্য একেক রকম নিউরন কাজ করে রেটিনায়। মস্তিষ্ক টের পাওয়ার আগেই রেটিনার এসব নিউরন জেনে যায় বস্তুর আসল চেহারা সম্পর্কে। পরে রেটিনা সে খবর পাঠিয়ে দেয় মস্তিষ্কের ঠিকানায়। মস্কিষ্ক শুধু সিদ্ধান্তটা আমাদের জানিয়ে দেয়।সার্নে ব্যবহারের লক্ষ্যে যে নতুন প্রসেসর তৈরি করা হচ্ছে, সে প্রকল্পের অন্যতম বিজ্ঞানী ডিয়াগো টোনেলি জানিয়েছেন, কৃত্রিম রেটিনা ঠিক মানুষের চোখের রেটিনার মতোই কাজ করবে। দ্রুততার সঙ্গে সংঘর্ষ বিশ্লেষণ করবে এটি। আগে টের পাওয়া যেত না এমন অনেক নতুন নতুন ঘটনা ধারণ করবে এ রেটিনা। সেগুলো কম্পিউটারের পর্দায় বড় আকারে পরখ করবেন বিজ্ঞানীরা। কৃত্রিম রেটিনার সুবাদে তাদের সামনে উন্মোচন হলেও হতে পারে কণাজগতের সম্পূর্ণ নতুন কোনো অধ্যায়।
Advertisement