মানব সম্পদ বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদের সঠিক যত্ন ও পরিচর্যার মাধ্যমে দেশ হয়ে উঠছে সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী। দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি এবং বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হচ্ছে। দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবাসী কর্মীদের প্রেরিত রেমিটেন্স এর অবদান জিডিপি’র প্রায় ১২ শতাংশের সমান। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য অভিবাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
Advertisement
সুশৃঙ্খল, নিরাপদ ও দায়িত্বশীল অভিবাসন নীতি ও তার সু-বাস্তবায়ন সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। বৈধ প্রক্রিয়ায় কর্মীরা নিরাপদে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাবে এবং কর্মকালীন সময় শেষে দেশে ফিরে আসবে এটাই সবার কাম্য। সে জন্য প্রয়োজন একটি দায়িত্বশীল অভিবাসন ব্যবস্থাপনা। এই উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সুষ্ঠু অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় ন্যায়সঙ্গত নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য প্রযোজ্য সাধারণ বিধানাবলী ও কার্যক্রম পরিচালনা-সংক্রান্ত নির্দেশাবলী বা General Principles & Operational Guidelines for Fair Recruitment, ২০১৬ প্রণয়ন করে।
ন্যায়সঙ্গত নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য প্রযোজ্য সাধারণ বিধানাবলীর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য সাধারণ বিধানাবলীসমূহ হলো- ‘নিয়োগ কর্মকাণ্ড এমনভাবে সম্পন্ন করিতে হইবে যেন উহা আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে বর্ণিত বিধান, বিশেষত সংগঠন করিবার স্বাধীনতা ও যৌথ দর কষাকষির অধিকারসহ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারসমূহকে মানিয়া চলে, সংরক্ষণ ও প্রতিপালন করে এবং জবরদস্তিমূলক শ্রম, শিশু শ্রম এবং কর্মে ও পেশায় বৈষম্য প্রতিরোধ ও বিলোপ করে। নিয়োগ প্রক্রিয়াকে অবশ্যই প্রচলিত শ্রম বাজারের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল হইতে হইবে এবং বিদ্যমান শ্রমশক্তিকে প্রতিস্থাপন কিংবা সংকুচিত করিবার পদ্ধতি রূপে উহাকে ব্যবহার করা হইবে না কিংবা শ্রম আইন বা মজুরি, কর্মের পরিবেশ কিংবা শোভন কাজকে অবমূল্যায়ন করিবে না এবং কর্মসংস্থান ও নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যথোপযুক্ত আইন ও পলিসি সকল শ্রমিক, শ্রমিক নিয়োগকারী ও কর্মী নিয়োগকারীগণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে।’ এই সাধারণ বিধানাবলীতে আরো উল্লেখ রয়েছে- ‘নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এরূপ বিধান ও পদ্ধতি অনুসরণ করিতে হইবে যাহার দ্বারা দক্ষতা, স্বচ্ছতা বজায় থাকে এবং পারস্পরিক দক্ষতা ও যোগ্যতার মাপকাঠির ভিত্তিতে শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষাকে উৎসাহিত করা হয়; কর্মসংস্থান ও নিয়োগ কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য প্রবিধান স্পষ্ট, স্বচ্ছ হইবে ও উহাকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করিতে হইবে। শ্রম পরিদর্শন দফতরের ভূমিকা এবং আইনানুগ নিবন্ধন, লাইসেন্সিং বা সনদ প্রদান ব্যবস্থাকে গুরুত্ব প্রদান করিতে হইবে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষসমূহকে জবরদস্তিমূলক শ্রম ও মানব পাচারের ঘটনাসহ হয়রানিমূলক ও প্রতারণাপূর্ণ নিয়োগের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য রাষ্ট্রীয় আইন, প্রবিধান, নিয়োগ চুক্তি ও কান্ট্রি অব অরিজিন, ট্রানজিট ও গন্তব্য দেশ বিষয়ক প্রযোজ্য যৌথ চুক্তিসমূহ এবং মূলনীতি ও কর্মক্ষেত্রের অধিকার ও প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক শ্রম আইনসমূহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হইতে হইবে।’
ন্যায়সঙ্গত নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য প্রযোজ্য সাধারণ বিধানাবলীতে গন্তব্য দেশ বিষয়ে বলা হয়েছে- ‘নিয়োগ কার্যের জন্য কোনো কর্মীর বা কোনো চাকুরি প্রার্থীর ওপর কোনো প্রকার ফি বা খরচ ধার্য করা যাইবে না কিংবা তাহাদের ওপর কোনো ব্যয়ভার আরোপ করা যাইবে না; কর্মীর কর্মের শর্তাবলী যথাযথ, যাচাইযোগ্য ও সহজবোধ্য আকারে বর্ণনা করিতে হইবে এবং সম্ভব হইলে রাষ্ট্রীয় আইন, প্রবিধান, নিয়োগ চুক্তি ও প্রযোজ্য যৌথ চুক্তির আওতাধীনে একটি লিখিত নিয়োগ চুক্তিপত্রের মাধ্যমে এসব শর্ত বর্ণনা করিতে হইবে। এসব শর্ত স্পষ্ট ও স্বচ্ছ হইবে এবং যেই কাজের জন্য শ্রমিকদেরকে নিযুক্ত করা হইয়াছে সেই কাজের স্থান, করণীয় ও দায়িত্ব সম্পর্কে তাহাদেরকে ধারণা প্রদান করিবে। দেশের ভেতরে অবাধে চলাচল করা অথবা দেশ ত্যাগ করিবার স্বাধীনতা কর্মীদের থাকিবে। কর্মীদের পরিচয় পত্র, এ সংক্রান্ত কাগজাদি ও চুক্তিপত্র বাজেয়াপ্ত, ধ্বংস কিংবা আটক রাখা যাইবে না; কর্মীর কর্ম পরিত্যাগ করিবার স্বাধীনতা ও অধিকার থাকিবে এবং অভিবাসী কর্মীদের স্বদেশে ফিরিয়া আসিবার অধিকার থাকিবে। কর্ম পরিবর্তনের জন্য অভিবাসী কর্মদেরকে নিয়োগকারীর অনুমতি গ্রহণ করিবার প্রয়োজন হইবে না।’
Advertisement
সরকার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গণকর্মসংস্থান পরিসেবা প্রদানকারীগণের দায়িত্বসমূহও এই গাউডলাইনে উল্লেখ রয়েছে। আইনি কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারসমূহের জন্য অনুসরণীয় হলো- ‘নিয়োগকারী ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক হিসেবে এবং সরকারি নিয়োগ কার্যক্রমের অধীন সঠিক কর্ম নির্বাচন ও নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে একটি সুষ্ঠু নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করা চূড়ান্ত বিচারে সরকারেরই দায়িত্ব। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দেশীয় ও অভিবাসী কর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানি হ্রাস করিবার লক্ষ্যে আইন ও প্রবিধানের ফাঁক-ফোকর দূর করিতে হইবে এবং আইন ও প্রবিধান পরিপূর্ণ রূপে প্রয়োগ করিতে হইবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গণ কর্মসংস্থান পরিসেবা প্রদানকারীগণ হয়রানিমূলক ও অশোভন নিয়োগ কার্যক্রম রোধকল্পে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করিবে।’
আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘নিরাপদ অভিবাসন যেখানে, টেকসই উন্নয়ন সেখানে।’ আইএলও প্রণীত ন্যায়সঙ্গতঃ নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য প্রযোজ্য সাধারণ বিধানাবলী ও কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত নির্দেশাবলী বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের স্বার্থ সুরক্ষা ও অধিকার সুনিশ্চিত করতে একটি কার্যকরি দলিল। এই বিধানাবলীর বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ নিরাপদ অভিবাসন এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে যথার্থ ভূমিকাও রাখবে। সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বিত সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার মাধ্যমেই ন্যায়সঙ্গত নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব।
লেখক : তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদপ্তর, ঢাকা।
এইচআর/পিআর
Advertisement