মতামত

আমরা জেগে আছি তোমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে

‘কি ভীষণ এক অদ্ভুত অভ্যাস আমার। বছরের দুটো মাসের বিশেষ কয়টা দিন আমি রাতের বেশির ভাগ সময় জেগে থাকি। অগাস্টের শেষ সপ্তায় আর ডিসেম্বরের মাঝের সপ্তায় এই রাত জাগার সময় শুরু হয়। রাত জেগে জেগে একাই পুরো বাড়ি পাহারা দেই।

Advertisement

হঠাৎ নীরব বুটের শব্দে ঘর ঘেরাও করবার কোন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কিনা, তাই কান পেতে রাখি। ঘটঘটে ক্যাঁচক্যাঁচ টায়ারের বিরক্তিকর ছাদ খোলা আর্মি জীপগুলো উঠোনের বড় কালো দরজায় এসে দাঁড়ায় কিনা, তাতে খেয়াল রাখি। বাড়িতে ঢুকবার জন্য কেউ এসে হাতের লাঠি দিয়ে খটখট শব্দ করে দরজা খুলতে বলে কিনা, তার জন্য অপেক্ষা করি।

আমি একাত্তরে হারিয়ে যাওয়া আমাদের সকলের বাবা মাকে পাহারা দেই। ঘুমহীন চোখে একেবারে ভোর পর্যন্ত টহল দিতে থাকি পুরো বাড়ি।'

এটি ১৩ ডিসেম্বর ফেসবুকে শাওন মাহমুদের স্ট্যাটাস। শাওন মাহমুদ একুশের গানের সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা। তার স্ট্যাটাসটি আমারও ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সত্যিই একাত্তরের আগস্ট আর ডিসেম্বর আমাদের ঘুম কাড়ানিয়া মাস। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা বাহিনী ছিল সবচেয়ে সাহসী বাহিনীর একটি। খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনায় মেজর হায়দার গড়ে তোলেন এই ক্র্যাক প্লাটুন। এই গেরিলারা যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম-কানুন মানতেন না। তারা যা করতেন, মাথায় ক্র্যাক থাকলেই কেবল তা করা সম্ভব। এ কারণেই এই বাহিনীর নাম ‘ক্র্যাক প্লাটুন’। কেউ কেউ বলতো বিচ্ছু বাহিনী।

Advertisement

২৫ মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পর কিছুদিন যেতে না যেতেই পাকিস্তানিদের মূল লক্ষ্য হলো সবকিছু স্বাভাবিক দেখানো। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা, অফিস-আদালত চলছে। আন্তর্জাতিক মহলে ঢাকা তথা বাংলাদেশকে স্বাভাবিক দেখানোটা ছিল তাদের বড় কৌশল। সেই কৌশলের গুড়ে বস্তা বস্তা বালি ঢেলে দেয় ক্র্যাক প্লাটুন। বিদেশিরা সবাই থাকতেন তখন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তাই সেখানে হামলা চালানো হয় দুবার। এছাড়া ফার্মগেট অপারেশন, ডিআইটি ভবনে টিভি স্টেশনে হামলা, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ক্র্যাক প্লাটুন ব্যতিব্যস্ত করে তোলে পাকিস্তানি বাহিনীকে।

ঢাকাকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। মেলাঘরে ট্রেনিং নেয়া ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধারা ঢাকায় থাকা মানুষের সহায়তায় অপারেশন চালাতেন। ঢাকায় থাকা মানুষদের কারো বাসায় অস্ত্র লুকিয়ে রেখে, কারো কাছ থেকে পাওয়া ম্যাপ তাদের অপারেশন সহজ ও সফল করে তুলতো। কিন্তু একাত্তরের আগস্টের ২৯ তারিখ গোপন খবরের ভিত্তিতে ক্র্যাক প্লাটুনের বিভিন্ন আস্তানায় অভিযান চালায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। ধরে নিয়ে যায় রুমী, আজাদ, জুয়েল, চুল্লুসহ অনেককে। পরদিন আউটার সার্কুলার রোডের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারক আলভীসহ অনেককেই।

আলতাফ মাহমুদের বাসা থেকে মাটি খুঁড়ে বের করে আনা হয় লুকিয়ে রাখা অস্ত্র। তাদের ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। তাদের অনেকেই আর ফিরে আসেননি। তাদের কোনো খোঁজও মেলেনি। তাই তাদের কোনো মৃত্যুদিবসও নেই। যেমন ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধা আজাদ রমনা থানায় তার মায়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। ভাত নিয়ে গিয়ে আর ছেলেকে পাননি সেই মা। সেই মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, আর কখনো ভাত খাননি। ছেলে রুমীর সাথে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শরীফ ইমামকেও। তিনি ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু পুত্রশোক সইতে পারেননি। বিজয়ের মাত্র তিনদিন আগে ১৩ ডিসেম্বর মারা যান তিনি।

আলতাফ মাহমুদকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেখা গেছে নাখালপাড়ার নির্যাতন কেন্দ্রে। তারপর আর তার কোনো খোঁজ মেলেনি। এই ৪৬ বছর পরও যখন সেদিনের নির্যাতন কেন্দ্র থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা যোদ্ধারা সেদিনের কথা বলেন, তাদের অজান্তেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। সেই নির্যাতনের কথা শুনলেও কারো পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব হয় না। কিন্তু আমাদের সেই বিচ্ছু যোদ্ধারা মুখ খোলেননি। তারা হারিয়ে গেছেন চিরদিনের জন্য, কিন্তু রেখে গেছেন বিজয়ের স্বপ্ন। আগস্টের শেষ সপ্তাহে তাই শাওন মাহমুদ ঘুমাতে পারেন না।

Advertisement

নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের আরেক বেদনাবিধুর মাস ডিসেম্বর। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা মেতে ওঠে এক নিষ্ঠুর পরিকল্পনায়। বিজয়ের পরও যাতে বাঙালি জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য বেছে বেছে তালিকা করে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। ডিসেম্বরের মাঝের সপ্তাহে খুব ঠান্ডা মাথায় চালানো হয় বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযান। মোহাম্মদুপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের টর্চার সেলে নির্যাতন শেষে হত্যা করে তাদের ফেলে দেয়া হয় রায়েরবাজারের পরিত্যক্ত ইটের ভাটায়। চোখের ডাক্তার আলিম চৌধুরীর চোখ তুলে ফেলা হয়। হার্টের ডাক্তার ফজলে রাব্বীর হার্ট খুলে ফেলে ঘাতকরা।

শাওন মাহমুদ তাই আগস্টের শেষ সপ্তাহে আর ডিসেম্বরের মাঝের সপ্তাহ এলে ঘুমাতে পারেন না। হারিয়ে যাওয়া বাবা-মাদের জেগে জেগে পাহারা দেন। শাওন মাহমুদ একদিন দুঃখ করে বলছিলেন, আলতাফ মাহমুদের নাম কোনো তালিকায় নেই; না মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়, না শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায়। একটি জাতির গৌরবের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানতে মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা থাকা খুবই দরকার। কিন্তু এখন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকা যতটা গৌরবের, ততটাই বাণিজ্যের। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। মিলছে ভাতা, চাকরি বাড়তি সুবিধা, পরিবারের সদস্যদের চাকরিতে কোটা। আর এসব সুবিধা পেতে অনেকেই নাম লেখাতে চান তালিকায়।

মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে গত কয়েকবছরে এমন সব কান্ডকারখানা হয়েছে, বয়স একবার বাড়ে, একবার কমে; দেখেশুনে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। ভুয়া সার্টিাফিকেট বাগিয়ে নানা সুবিধা নেয়ার অনেক গল্প শুনি। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সবচেয়ে সম্মানের আসনে। একজন মানুষ জীবনে মন্ত্রী-এমপি অনেককিছুই হতে পারবে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের শেষ সময়টা নির্বিঘ্ন করা অবশ্যই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ঢুকতে না পারা। তদ্বির করে অমুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ঢুকে যাওয়া দেখে এই তালিকা সম্পর্কে আমার মোহমুক্তি ঘটেছে। তাই আলতাফ মাহুমুদের নাম কোনো তালিকায় নেই জেনে আমি অবাক হইনি, কষ্ট পাইনি। আলতাফ মাহমুদরা বেঁচে আছেন কোটি মানুষের ভালোবাসায়, কোটি তরুণের স্বপ্নে, কোটি শিশুর আকাঙ্খায়। সেখান থেকে কেউ তাদের মুছে ফেলতে পারবে না।

জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানরা জীবন দিয়েছিল বলেই আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে গর্ব করি। কিন্তু শহীদদের আগলে রাখা, তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব শুধু শাওন মাহমুদের নয়, আমাদের সবার। ১৪ ডিসেম্বর পালিত শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে। কিন্তু আগস্টের শেষ সপ্তাহটিকে আমরা সেভাবে স্মরণ করি না। কিন্তু শুধু বছরে একটি দিন স্মরণ করলেই শহীদ বুদ্ধিজীবী বা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পাবে?

আমাদের সঙ্গীতকে যদি আমরা উৎকর্ষের চূড়ায় নিতে পারি, তাহলে শান্তি পাবে আলতাফ মাহমুদের আত্মা। সাংবাদিকতাকে যদি সব ভয় ও পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারি, তাহলেই সার্থক হবে সিরাজুদ্দীন হোসেন-সেলিনা পারভিনের আত্মদান। বাংলা সাহিত্য-নাটককে যদি আমরা বিশ্বমানে উত্তীর্ণ করতে পারি, তাহলেই ওপারে ভালো থাকবেন মুনীর চৌধুরী-শহীদুল্লাহ কায়সার-আনোয়ার পাশারা। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে যদি আরো মানবিক করে তুলতে পারি, তাহলেই আলীম চৌধুরী-ফজলে রাব্বীর স্বজনদের বেদনার কিছুটা উপশম হবে।

আসলে শুধু মুখে মুখে স্মরণ করা নয়; আমরা যদি শহীদদের স্বপ্নের মত করে একটি উন্নত, সমৃদ্ধশালী, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে পারি, তাহলেই কেবল তাদের ত্যাগের প্রতি সত্যিকারের সম্মান জানানো হবে। তাহলেই অর্জিত হবে প্রকৃত বিজয়।

১৪ ডিসেম্বর, ২০১৭probhash2000@gmail.com

এইচআর/এমএস