১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামক নতুন একটি দেশের পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় হয়। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ পাকিস্তানি হানাদার-দখলদার বাহিনী, তাদের দেশীয় অনুচর রাজাকার-আলবদর বাহিনী ও বিদেশি মদতদাতা, অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশ, সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র প্রমুখ শক্তিকে পরাজিত করে বাঙালি জাতি ছিনিয়ে এনেছিল এই বিজয়। বিজাতীয় শাসনের নাগপাশকে ছিন্ন করে সেদিন পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন রাষ্ট্র, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক এই দিনটি বাঙালি জাতির জন্য গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসার গর্ব ও আনন্দের তাৎপর্য বহন করে।
Advertisement
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছেন, শুধু ভিক্ষা করে কখনও স্বাধীনতা লাভ করা যায় না। স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় শক্তি দিয়ে, সংগ্রাম করে। স্বাধীনতার মূল্য দিতে হয় রক্ত দিয়ে। সে সর্বোচ্চ মূল্য আমরা দিয়েছি। ৩০ লাখ তাজা প্রাণের বিনিময়ে আমরা লাল সবুজের পতাকাটি পেয়েছি। পৃথিবীর কোনো জাতি এতো রক্ত দিয়ে তার স্বাধীনতা লাভ করেনি।
শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, একটি উদার ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারী মুক্তি আন্দোলন, নারী শিক্ষার প্রসার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে শেষ করাসহ ন্যায়ভিত্তিক আদর্শে ১৯৭২ সালে বিজয়ী দেশের বহুল প্রত্যাশিত সংবিধান রচিত হয়।
স্বাধীনতার সাড়ে চার দশকে আমদের প্রাপ্তি কোনো অংশে কম নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের ফলে দেশে আমূল পরিবর্তন লক্ষণীয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর পদচারণা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাক্ষরতার হার বেড়েছে। কমেছে দারিদ্রতা। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া হিসেবে নির্বাচন ব্যবস্থা আরো স্বচ্ছ ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্থায়ী হয়েছে বহু দলীয় ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক রাজনীতি বারবার হোঁচট খেলেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মাধ্যমে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করা হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার করার মধ্য দিয়ে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা হয়েছে।
Advertisement
ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিশন বাস্তবায়নের ফলে একটি অন্য বাংলাদেশ সবার চোখে দৃশ্যমান; শিশু মৃত্যুহার, মাতৃত্বকালীন মৃত্যু, সর্বজনীন শিক্ষা, শিক্ষায় নারী-পুরুষ বৈষম্য এসব দিক দিয়ে বাংলাদেশ নিজের অবস্থানের প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী অনেক রাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে। সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি তুলনা তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশকে শোষণ-নিপীড়নে নিষ্পেষিত করতে চেয়েছিল যে দেশটি, এখন অনেক কিছুতে তার চেয়ে এগিয়ে আছে সে। গত ৪৬ বছরের অগ্রগতিতে বাংলাদেশের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ এখন পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ১ হাজার ৫৩৮ ডলার। সেখানে পাকিস্তানের তা ১ হাজার ৪৭০ ডলার। তাছাড়া উল্লেখ করার মতো আরও একটি উদাহরণ এখানে টেনে আনা যায়- স্বাধীনতার পর যেখানে মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার লড়াইয়ে নেমেছিল বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশই এখন গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে (বিশ্ব ক্ষুধাসূচক) পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে। ২০১৭ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮; যেখানে পাকিস্তানের ১০৬।
আমাদের শ্রমিকেরা বিদেশের উৎপাদনে অংশ নিয়ে তাদের ভাগ হিসেবে প্রতিবছর দেশে নিয়ে আসছেন বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার। সাথে যোগ হচ্ছে আমাদের পোশাক-শ্রমিকদের কর্মফল। অন্যদিকে দেশে সামগ্রিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। সবমিলে খুব শিগগিরই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার আশাই জোরালো হচ্ছে; ইতোমধ্যে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করেছেন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে অবস্থান করবে। বিশ্বের নানান পরিসংখ্যানও বর্তমানের গতিধারা পর্যবেক্ষণ করে এই আশাবাদে সহমত পোষণ করেছেন। এমন একটি সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই সন্তান সে স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
লেখক: কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সাবেক সংসদ সদস্য।
এআরএস/এমএস
Advertisement