মতামত

যে ঋণগুলো শোধ করা দরকার

পেশাগত কাজে ধারাবাহিক লেখা লিখছিলাম। বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। সেই সূত্রে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছিলাম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট, প্রবন্ধ নিবন্ধ, পদক তালিকাও দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বড়ই অসম্পূর্ণ। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশ। এই দেশে শহীদের নামের পূর্ণ তালিকা করা কি একান্তই অসম্ভব কোন বিষয়? মুক্তিযোদ্ধাদেরও বীরত্বের কোন পূর্ণাঙ্গ বিবরণ নেই। যা আছে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ভাটি অঞ্চলের দুর্দান্ত বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস, ঢাকার গেরিলাযোদ্ধা শহীদ আবদুল্লাহ হিল বাকী, পিরোজপুরের গেরিলাযোদ্ধা শহীদ ভাগিরথী সাহার মতো সাহসী, বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা ক’জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের ইতিহাস বলতে পারবো?

Advertisement

প্রসঙ্গক্রমে একটু ব্যক্তিগত কথা বলি। আমার বাবার চাচাতো ভাই এবং তার এক ছেলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তার আরেক সন্তান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। অথচ এই শহীদদের নাম পরিবারের বাইরে কেউ জানেন না। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান শহীদ রুমির কথা আমরা জানতে পারি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ থেকে। শহীদ আজাদের কথা জানতে পারি আনিসুল হকের উপন্যাস থেকে। কিন্তু শহীদ রুমি, শহীদ আজাদের মতো আরও অনেক বীর শহীদ আমাদের দেশে ছিলেন। তাদের বীরত্বের কথা পরিবারের বাইরে বা সুহৃদ, সহযোদ্ধাদের বাইরে হয়তো কোথাও প্রচারিত হয়নি।

যুদ্ধশিশুদের ইতিহাস আমাদের একটি অনুদ্ঘটিত অধ্যায়। লুকিয়ে রাখা হয়েছে যুদ্ধাহত নারীদের কথাও। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের যে নারীরা যুদ্ধাহত তাদের পরিচয় অনেক সময়ই গোপন রাখা হয়েছে। ‘সম্ভ্রম হারানো’ নামে একটি ভুল শব্দগুচ্ছের কারণে যুদ্ধাহত নারীদের ইতিহাসকে গোপন রাখার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। একাত্তরে এই যুদ্ধাহত নারীরা কেন ‘সম্ভ্রম’ হারাবেন? একাত্তরে ‘সম্ভ্রম’ হারিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী। তারা বিশ্বের কাছে ধর্ষকের জাতি, বর্বর, নরপশু হিসেবে পরিচিত হয়েছে তাদের জঘন্য কর্মকাণ্ডের কারণে। বাংলার নারীরা কেন ‘সম্ভ্রম’ হারাবেন? তারা তো অন্যায় কিছু করেননি। তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ১৯৭১ সালের ভয়াবহ গণহত্যার ইতিহাসও অনেক ক্ষেত্রে হারিয়ে যাচ্ছে। ১ ডিসেম্বর জনতা জুটমিলে পাকিস্তানি মেজর আরিফের নির্দেশে যে ভয়াবহ গণহত্যা হয় তার ইতিহাসই বা আমরা ক’জন জানি?

খোঁজ নিলে দেখা যাবে বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারে (সেটা এক্সটেনডেড ফ্যামিলি হতে পারে) কেউ না কেউ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে কোন না কোনভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন এমন মানুষের দেখাও প্রায় প্রতিটি পরিবারে পাওয়া যাবে। আমার ধারণা মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখের কম তো নয়ই বরং বেশি হতে পারে। সকল শহীদই শ্রদ্ধেয়। তাই তাদের নামের তালিকা থাকাটা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীরা আজও বেঁচে আছেন। উপজেলাভিত্তিক ভাবে তাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে শহীদের নামের তালিকা হওয়া দরকার। আর বীরপ্রতীক, বীর বিক্রম খেতাব যারা পেয়েছেন তাদের বীরত্বের বিবরণ লিপিবদ্ধ থাকা উচিত। এমনকি যারা খেতাব পাননি কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তাদের বীরত্বের বিবরণও লিপিবদ্ধ থাকা প্রয়োজন।

Advertisement

যারা যুদ্ধাহত নারী বা ধর্ষণের শিকার তাদের নামও থাকা দরকার। কারণ তারা জাতির অহংকার। হিসাব নিলে দেখা যাবে যুদ্ধাহত নারীর সংখ্যা তিন থেকে চার লাখ হবে। যুদ্ধাহত নারী ও যুদ্ধশিশুদের প্রাপ্য মর্যাদা আমাদের হতভাগ্য সমাজ দিতে পারেনি। এই ঋণগুলো শোধ হওয়া দরকার। যুদ্ধে যে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে (সদ্যোজাত হলেও) তাদেরও নাম বা বিবরণ থাকতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে যুদ্ধশিশুদের।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির পরম গৌরব। এই দেশের সাধারণ মানুষ জনযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আমরা বীরের জাতি। শুধু তরুণ যুবকই নয় আমাদের কিশোররাও বীর, আমাদের নারীরাও বীর। তারা পাকিস্তানিদের ভয়ংকর নির্যাতনের মুখেও আপোস করেননি, কারও মুক্তিযোদ্ধা ভাই, স্বামী, বাবার নাম কেউ শত্রুর কাছে প্রকাশ করেননি। যারা অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের খাদ্য সরবরাহ করেছেন তারাও গেরিলা যোদ্ধা। আমরা কারও দয়ায় এই স্বাধীনতা পাইনি। আমাদের নিজেদের সাহস, শক্তি ও বীরত্বে অর্জন করেছি। পরবর্তী প্রজন্ম এবং ইতিহাসের কাছে আমাদের দায় রয়েছে। আমরা এই ইতিহাস যদি না রেখে যেতে পারি তাহলে ভবিষ্যত আমাদের ক্ষমা করবে না।

কোন না কোনদিন পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ এই প্রশ্ন তুলবেই যে, কেন আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের বিবরণ, শহীদদের নাম, যুদ্ধাহত নারীদের নাম সংরক্ষণ করিনি? এই দায়িত্ব সরকারের বা কোন মন্ত্রণালয়ের একক নয়। বেসরকারিভাবেও এই কাজ হতে পারে। তবে সরকারি সমন্বয় দরকার। আমরা যারা সচেতন তারা যার যার গ্রামের, পাড়ার, মহল্লার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা লিখি না কেন? নিদেনপক্ষে নিজ পরিবারের শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা বা যুদ্ধাহত নারীর বিবরণ লিখি। সেটাই তো ভবিষ্যত ইতিহাস রচনার পথ খুলে দিতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন নানাভাবে। কখনও খবর আদান প্রদান করে, কখনও অস্ত্র লুকিয়ে রেখে, কখনও তাদের আশ্রয় ও খাদ্য দিয়ে। আমার বাবাও তাদের একজন। এই মানুষদের কোন অবদানই কি মুক্তিযুদ্ধে নেই? তারা কি গেরিলাযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নন? তাদের ভূমিকাও লিখে রাখা দরকার।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ভিত্তি। মুক্তিযুদ্ধের পদকতালিকা দেখলে মনে হতে পারে সামরিক, আধাসামরিক ও পুলিশ বাহিনীর মানুষরাই বুঝি শুধু মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। কিন্তু প্রকৃত সত্য তা নয়। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, গৃহবধূ, কিশোর এরা যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে তা ইতিহাসে তুলনাহীন। বিবরণ থাকা দরকার গণহত্যার। চিহ্ন থাকা দরকার বধ্যভূমির। পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকার, আলবদর, আল শামস যে পাপ যে ভয়ংকর অপরাধ করেছে তা যেন আমরা ভুলে না যাই। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করা দরকার। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদেরও ক্ষমা চাওয়াতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরিয়ার নারীদের উপর নির্যাতন চালিয়েছিল জাপান। সেই ভূমিকার জন্য পরে তারা ক্ষমা চায়। পাকিস্তানেরও উচিৎ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া। তাহলে শহীদের আত্মা শান্তি পাবে।

Advertisement

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/আইআই