মতামত

আমজাদ সাহেবের মত মানুষদের মৃত্যু নেই

দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প পরিবার প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরীর সাথে আমার পরিচয় সামরিক বাহিনীতে থাকার সময়ই। তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন। সেই সময়ই দেখেছি একজন কর্তব্যনিষ্ঠ অফিসার হিসেবে তার রয়েছে অনেক গুণ। তার অধস্তনদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার অপূর্ব দক্ষতা ছিল তাঁর। সকলের সঙ্গে সর্ম্পকও ছিল অত্যন্ত মধুর। যে কারো যে কোনো সমস্যায় নিজ থেকেই তিনি এগিয়ে যেতেন। এ জন্য সহকর্মীদের মধ্যে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। কাজের ক্ষেত্রে তিনি সবকিছু ঠিকঠাক বুঝে নিতেন। শর্টকাট কোনোকিছু পছন্দ করতেন না। এছাড়া তিনি ছিলেন একজন পারফেক্টসনিস্ট মানুষ। অর্থ্যাৎ কাজে কোনো খুঁত তিনি পছন্দ করতেন না। যেটা শুরু করতেন সেটি সুন্দরভাবে শেষ না করা পর্যন্ত তিনি থামতেন না। অবসর নেওয়ার পর আশির দশকে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। যে সময় এবং যেভাবে তিনি এই ব্যবসা শুরু করেন সেটি ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। স্বল্প পূঁজি নিয়ে সংগ্রাম করে তিনি উপরে উঠে এসেছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল তার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই। যেগুলো আমি আগেই বলেছি। অর্থাৎ কাজের প্রতি মনোযোগ, নিষ্ঠা, দক্ষতা এবং আন্তরিকতা সর্বোপরি কাজ বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা তাকে এই পর্যায়ে উঠিয়ে আনে। বলতে দ্বিধা নেই প্রাণ-আরএফএলকে তিনি যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন সেটি অন্য কারও পক্ষে সম্ভব হতো না। এবং তাঁর নিরন্তর নিরলস চেষ্টা এবং কাজের প্রতি অধ্যবসায় তাঁকে এই প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর কোনো দুর্নাম ছিল না। আমাদের দেশে যে ঋণখেলাপি কালচার সেখান থেকেও তিনি দূরে ছিলেন। অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে তিনি সব সময় নিজের পায়ে দাঁড়াতে পছন্দ করতেন। এক্ষেত্রে স্বচ্ছ থাকার ব্যাপারেও তাঁর আন্তরিকতার কোনো কমতি ছিল না। চাকুরি জীবনে সহকর্মীদের উপকার করার যে মানসিকতা ছিল তা তিনি আমৃত্যু করে গেছেন। আমি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে থাকার সময় দেখেছি সহকর্মিদের প্রতি তার আন্তরিকতার বিষয়টি। মালিকসুলভ কোনো প্রভাব তিনি খাটাতেন না। বরং একজন সিনিয়র মুরব্বি হিসেবে তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের ছায়ার মতো। সহকর্মিদের তিনি আগলে রাখতেন। পরামর্শ দিতেন। কাজ বুঝে নিতেন। সবাইকে কাজের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতেন। কিন্তু কারো সাথেই মালিক-শ্রমিক কিংবা কর্মকর্তার দূরত্ব নিয়ে মিশতেন না। এসব কারণেই আজকে তাঁর প্রতিষ্ঠান শুধু দেশেই নয় বিদেশেও অনেক ভাল করছে। সবচেয়ে বড় কথা তাঁর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য তিনি পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ তাঁর  সন্তানদের মধ্যে  প্রতিফলিত করতে পেরেছেন। তাঁর সন্তানরাও মানুষের মতো মানুষ হয়েছেন। এখন যে ডিএমডি আহসান খান চৌধুরী তিনিও বাবার মতোই অনেক গুণের অধিকারী। আমজাদ সাহেবের শুন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়। তবুও আশা করব তার সন্তানরা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপকে আরও অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবেন। যেমনভাবে এই বেকারত্বের দেশে বহু মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে আমজাদ সাহেব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।পরবর্তী প্রজন্মকেও এটি ধরে রাখতে হবে। আমজাদ সাহেবের সময় যেভাবে কোম্পানি সুনামের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে গেছে সেটি ধরে রাখতে হবে। তাহলেই তার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হবে। প্রাণ-আরএফএল-এর বর্তমান নেতৃত্ব এটি মনে রাখবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরীর মৃত্যুতে দেশ শুধু একজন সফল ব্যবসায়ীকেই হারালো না একজন কর্তব্যনিষ্ঠ এবং পরোপকারী মানুষকেও আমরা হারালাম। তার চলে যাওয়াই শেষ কথা নয়। নিজের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই তিনি বেঁচে থাকবেন।  বেঁচে থাকবেন অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে যাদের জন্য তিনি অনেক কিছু করে গেছেন। আমি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সফল ব্যবসায়ীদের তালিকার অগ্রভাগে তাঁর নাম রাখবো।  এবং তিনি যে একজন অনুকরণীয় মানুষ ছিলেন, তার জীবন থেকে অনেক কিছু যে শেখা যায় সেটিও বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি। তাঁর পরিবার এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কর্মকর্তা এবং কর্মচারিরা এই শোক কাটিয়ে উঠার সামর্থ্য লাভ করুক সেই প্রার্থনাও করি। পরিশেষে বলব, আমজাদ সাহেবের মত মানুষদের আসলে মৃত্যু নেই। তারা বেঁচে থাকেন তাঁদের কর্মের মধ্যেই। তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়..‘নয়ন সমুখে তুমি নাই  নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই....।

Advertisement