খেলাধুলা

গেইলের অবিশ্বাস্য ছক্কা বৃষ্টির সাক্ষী হলো শেরে বাংলা

তার কত নাম! নানা বিশেষণ। কেউ তাকে ভালবেসে ডাকেন, ‘ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের অলস সিংহ।’ বেশিরভাগ ক্রিকেট অনুরাগী ক্রিস গেইলকে বলেন ‘ভয়ঙ্কর’ ব্যাটসম্যান।

Advertisement

না বলার কোনো কারণই নেই! সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ক্রিস গেইল এক ‘ঝড়ের নাম।’ গেইল ঝড় ওঠা মানে সব লণ্ডভণ্ড হওয়া। প্রতিপক্ষ বোলিং-ফিল্ডিং তছনছ হয়ে পড়ল।

সেই গেইল যদি জীবন পান, কেউ যদি তার ক্যাচ ফেলে দেয়, তাহলে কি হয় জানেন? গেইল হয়ে ওঠেন ‘গুলি খাওয়া আহত বাঘ।’ আজ শেরে বাংলায় বিপিএল ফাইনালে ক্যাচ ফেলে গেইলকে সেই ‘গুলি খাওয়া আাহত বাঘ’ বানিয়ে দিলেন ঢাকা ডায়নামাইটস অধিনায়ক সাকিব আল হাসান।

রংপুর রাইডার্সের ইনিংসের বয়স তখন মাত্র ছয় ওভার। গেইলের রান মোটে ২২। বোলার অনিয়মিত অফস্পিনার মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। তার বলে সপাটে অফসাইডে চালালেন গেইল। বল চলে গেল কাভারে দাঁড়ানো সাকিবের হাতে। বুক সমান উচ্চতায় আসা সে ক্যাচ হাতে নিয়েও ফেলে দিলেন ঢাকার অধিনায়ক। তখন কেউ কেউ বলেছেন, ‘আরে ক্যাচ তো খেলারই অংশ। ক্যাচ ড্রপ হতেই পারে।’

Advertisement

আবার প্রেস বক্সে কে একজন বলে উঠলেন, সর্বনাশ! গেইলের ক্যাচ ড্রপ! নিশ্চিত ঢাকাকে চরম মাশুল দিতে হবে। অন্য আরেকজন বলে উঠলেন, ক্যাচ তো পড়লো না, ম্যাচও হাত থেকে বেরিয়ে গেলো।

শেষ পর্যন্ত ওই কথাই সত্য হলো। গেইল ঝড়ে লণ্ডভণ্ড ঢাকা। গেইল রুদ্রমূর্তি ধারণ করলে কতটা বিপজ্জনক হতে পারেন, তা আগেও জানা ছিল। এই তো ৭২ ঘন্টা আগে এই শেরে বাংলায় ইলিমিনেটের রাউন্ডে খুলনা টাইটান্সের সাথে ১৪ ছক্কায় হাঁকিয়েছিলেন ১২৬ রানের উত্তাল ইনিংস। আজ সেটাও ছাড়িয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত খেললেন ৬৯ বলে ১৪৪ (১৮ ছক্কা ও ৫ বাউন্ডারি) রানের উত্তাল ইনিংস।

গেইলের এই ইনিংসটি শুধু যে ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়েছে তা নয়। এ যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মিশন ছিল তার। আজ শেরে বাংলায় এক নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়লেন তিনি। এতদিন তার এক ইনিংসে সর্বাধিক ছক্কা ছিল ১৭টি। আজ ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে সে সংখ্যা অতিক্রম করে এক ইনিংসে সর্বাধিক ১৮ ছক্কার মালিক বনে গেলেন এ ক্যারিবিয়ান।

শেষ ছক্কাটিও বেশ রোমাঞ্চ জাগানো। রংপুর ইনিংসের শেষ ওভারে বোলার ছিলেন ঢাকা অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। তার ওই ওভারের পঞ্চম বলে গেইলের জোরালো অন ড্রাইভ চলে গেল লং অনে সীমানার কাছাকাছি।

Advertisement

অনায়াসে সিঙ্গেলস নেয়া যায়। অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকানরা হলে হয়ত প্রাণপন ছুটে ডাবলস নিয়ে ফেলতেন। সেখানে গেইল কোনো রানই নিলেন না। নিজেই স্ট্রাইকে থেকে গেলেন। অপরপ্রান্তে ম্যাককালামকে নিষেধ করলেন রান নিতে।

কেন থাকলেন? সিঙ্গেলস নিলেন না কেন? সেঞ্চুরি তো পূর্ণ হয়েছে বহু আগেই। এমন নয় শেষ বলে ছক্কা হাঁকালে দেড়শ বা আরও বড় কোনো মাইলফলক ছোঁয়ার সম্ভাবনা ছিল। তার রান তখন ১৪০। তাহলে ইনিংসের এক বল আগে কেন সিঙ্গেলস নিলেন না? তা নিয়ে গুঞ্জন। ফিসফাস।

পরিসংখ্যান ঘাঁটাঘাটি করতেই বেড়িয়ে এলো, ঠিকই আছে কেন তিনি সিঙ্গেলস নিয়ে ননস্ট্রাইক এন্ডে আসবেন? শেষ বলে ছক্কা হাঁকাতে পারলে যে তার টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সর্বাধিক ১৮ ছক্কা হয়ে যাবে! বোঝাই গেল, তা ঠিক মাথায় ছিল তার। আর তাই শেষ বলটি নিজেই খেললেন।

কি অসাধারণ আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে শেষ বলটি লং অনের ওপর দিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে ছক্কা হাঁকালেন। সঙ্গে সঙ্গে এক ম্যাচে নিজের হাঁকানো ১৭ ছক্কার বদলে এবার ১৮ ছক্কা হাঁকানোর নতুন বিশ্ব রেকর্ড হলো ।

যার আগে ১৭ ছক্কা হাকানোর রেকর্ড আছে, তিনি আর একটি বেশি ছক্কা হাঁকিয়ে ১৮‘তে গিয়ে থামলেন। বল থাকলে নির্ঘাত সে সংখ্যা আরও বাড়তো। তখন গেইলের ছক্কা কতগুলো হতো? তা নিয়েও ছোটখাট বিতর্ক হতে পারে।

যাই হোক, একটা কথা বলাই যায়। গেইলের এমন ছক্কা বৃষ্টির পর সমালোচকদেরও মুখ বন্ধ। ‘বিপিএল করে কি হবে? বিপিএল আয়োজনের স্বার্থকতাই বা কী?’ সবাই নন। কেউ কেউ এমন তীর্যক কথাবার্তা বলেন প্রায়ই।

তবে আজকের ফাইনালের পর তারাও লজ্জা পেয়ে গেলেন। নিজে থেকেই বললেন, ‘আরে বিপিএল হওয়াতেই না এমন ছক্কার অনুপম প্রদর্শনী দেখতে পেলাম। না হয় টিভি সেটের সামনে বসেই গেইলের ছক্কা বৃষ্টি দেখতে হতো আইপিএল, সিপিএল কিংবা বিগ ব্যাশ লিগে।

সর্বাধিক ছক্কার কারণেই এ ইনিংসটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে গেইলের কাছে। আর এ ম্যাচ তথা গেইলের এমন বিধ্বংসী উইলোবাজি মাঠে বসে দেখা দর্শকদেরও আজীবন মনে থাকবে। এ অতি মানবীয় ইনিংসটির কিছু খুঁটিনাটি পরিসংখ্যান-

পুরো ইনিংসে ৬৯ বল খেললেও ২৮টি বল ছিল তার ডট। তার মানে তার স্কোরিং শট ছিল ৪১টি। এর মধ্যে ১৮ রান নিয়েছেন দৌড়ে। তার সবগুলোই সিঙ্গেলস। কোনো ডাবলস নেই। তিন রান নেবার প্রশ্নই আসে না। শুধু চার ও ছক্কা থেকেই এসেছে ১২৮ রান।

গেইলের ১৭৫ রান তো টিভিতে দেখেছি। আর বিপিএলে তার করা আগের চার শতরানের সবগুলোই দেখা হয়েছে সরাসরি। এখনো মনে আছে প্রথম বিপিএল খেলতে এসে প্রথম দিনই ঝড় তুলেছিলেন গেইল।

সেবার পাঁচ ম্যাচে দুই সেঞ্চুরিসহ ১৮৭.০১ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন ২৮৮ রান। গড়ও ছিল দুর্দান্ত; ৯৬.০০। পরেরবার মানে ২০১৩ সালে দ্বিতীয় আসরে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের হয়ে একটি মাত্র ম্যাচ খেলেছেন। সে ম্যাচে ২২৩.৫২ স্ট্রাইক রেটে ৫১ বলে ১২ ছক্কা আর পাঁচ বাউন্ডারিতে ১১৪ রানের বিধ্বংসি ইনিংস খেলে গেছেন এ দীর্ঘদেহী ক্যারিবিয়ান।

প্রথম দুই বছর তার ব্যাটে রানের ফলগুধারা বইলেও তৃতীয় ও চতুর্থ আসরে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। ২০১৫ সালে তৃতীয়বার বিপিএল খেলতে এসে ১৬৩.৫২ স্ট্রাইক রেটে চার ম্যাচে করেন ১৩৯ রান। সেবারই প্রথম কোনো ম্যাচে তিন অংকে পৌঁছাতে পারেননি তিনি। পঞ্চাশের ঘরে পৌঁছান মাত্র একবার। সর্বোচ্চ ছিল ৯২।

আর গত বছর মানে, ২০১৬ সালের বিপিএলে দেখা মিলেছে অন্য গেইলের। চিটাগং ভাইকিংসের পক্ষে পাঁচ ম্যাচে একবারের জন্যও জ্বলে ওঠেনি তার ব্যাট। সাকুল্যে করেছেন ১০৯ রান। একবারের জন্য পঞ্চাশের ঘরেও পা রাখা সম্ভব হয়নি। সর্বোচ্চ ৪৪। ২১.০০ গড়। স্ট্রাইকরেটও (১২৩.৮৬) ছিল আগের যেকোনো বারের তুলনায় কম।

এবারও প্রথম ৯ ম্যাচে তেমন সুবিধা করতে পারেননি তিনি। দুটি ম্যাচে পঞ্চাশের ঘরে পৌঁছালেও সর্বোচ্চ ৫১‘তেই থমকে দাড়িয়েছিলেন; কিন্তু ইলিমিনেটর রাউন্ড আর ফাইনালে একজোড়া সেঞ্চুরি, তাও ছক্কার বিশ্ব রেকর্ড গড়ে- তা শুধু চিরচেনা গেইলকেই মনে করিয়ে দিল না, দেখে মনে হলো আরও ভয়ঙ্কর, আরও বিধ্বংসী উইলোবাজি করার সামর্থ্য আছে ৩৮ বছর বয়সী গেইলের। এআরবি/আইএইচএস/এমএস