খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বছর খানেক আগে হবে হয়তো। শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানের সঙ্গে একদিনের সীমিত ওভারের ম্যাচ চলছিল বাংলাদেশের। স্টেডিয়াম ও তার আশপাশে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনি। গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড, গ্যালারি, ক্লাব হাউজে টিকেট কেটেও ঢোকা দায়। কিওরেটর, মাঠ কর্মী, আম্পায়ার ও ম্যাচ রেফারি ছাড়া মাঠে ঢোকার অনুমতি নেই কারো। চারদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন। বিসিবির নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীরাও মাঠের সব দিকে অবস্থান নেয়া।
Advertisement
এর মধ্যে বলা নেই কওয়া নেই এক যুবক সব নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেদ করে ঢুকে পড়লেন মাঠের ভেতরে। তার লক্ষ্য মাশরাফির সঙ্গে আলিঙ্গন করবেন। প্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফিকে ছুয়ে দেখবেন। ভক্ত হিসেবে সেটা তিনি করতেই পারেন। কিন্তু সময় ও পরিবেশ মোটেই অনুকূল ছিল না। খেলা চলাকালীন ফিল্ডিংয়ে থাকা মাশরাফির সঙ্গে মাঠে গিয়ে দেখা করা নিয়ম ভাঙার সামিল। আইন শৃঙ্খলা ভঙের মত অপরাধ। তাকে ধরতে মাঠের ভেতরে ছুটলেন নিরাপত্তা কর্মীরা। মাঠে থাকা বাংলাদেশ দলের ১১ জন ক্রিকেটার, দুই আম্পায়ার ও দুই আফগান ব্যাটসম্যানসহ সবাই হতচকিৎ! ঠিক কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। রুদ্ধশ্বাস মাঠে ঢোকা ঐ তরুণের পেছন পেছন মাঠে ঢুকে পড়লেন সাত আটজন নিরাপত্তা কর্মী। তাদের কেউ ঐ ভক্তকে ধরার আগে মাশরাফি ফিল্ডিং পজিশন থেকে ছুটে গিয়ে ঐ ভক্তকে জড়িয়ে ধরলেন।
খেলা চালকালিন মাঠে ঢোকা রীতিমত অপরাধ। ঐ অতি উৎসাহী দর্শক সেই অপরাধে দুষ্ট। খুব স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে মারপিট করতে পারেন। হয়তো করবেনও। তাই মানবিক কারণে মাশরাফি দৌড়ে গিয়ে তাকে জাপটে ধরে রাখলেন। তারপর একদম মাঠের বাইরে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের পশ্চিম-উত্তর দিক ঘেঁষে গ্রাউন্স কমিটির রুমের পাশে থাকা গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে নিরাপত্তা কর্মীদের কাছে অনুরোধ করলেন তার গাঁয়ে হাত না তুলতে।
সেখানেই শেষ নয়। ঐ দিন খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনেও মাশরাফি ঐ দর্শক ভক্তর কথা জিজ্ঞেস করেছেন। খেলা শেষে কর্তব্যরত নিরাপত্তা বাহিনীর ও নিরাপত্তা কর্মীদের কাছে ঐ অতি উৎসাহি দর্শকের খোঁজ খবরও নিয়েছেন। এটাই তার রূপ। এখানেই মাশরাফি ব্যতিক্রম। অনন্য।
Advertisement
‘বিনয়’ তিন অক্ষরের এ শব্দটি যেন তার জন্যই। এত বড় ক্রিকেটার। সবাই এক নামে চেনে, জানে। গাঁয়ে তারকার লেভেল আঁটা। কিন্তু সেই তারকা সুলভ গর্ব, অহমিকা কিছুই নেই তার। শত অর্জন, হাজারো প্রাপ্তি আর আকাশ ছোঁয়া কীর্তির মাঝেও অতি সাধারণ মানুষের মাঝে মিশে থাকেন, মিশে আছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ঠোঁটের কোনে সব সময় হাসি লেগেই থাকে। বড়দের সম্মান, ছোটদের স্নেহ ভালোবাসায় সিক্ত করায় তার জুড়ি মেলা ভাড়।
কাল (সোমবার) রাতে হট ফেবারিট ও রবিন লিগ শেষে সবার ওপরে থাকা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে হারিয়ে বিপিএলের ফাইনাল নিশ্চিত করার পরও সেই নিরঅহঙ্কারি বিনয়ী মাশরাফি। খেলা শেষে পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কয়েক মিনিট কথা বলে মিডিয়া ম্যানেজার রনির সঙ্গে শেরে বাংলার কনফারেন্স হলে আসতেও দেখা মিললো সেই চির চেনা মাশরাফির। সাংবাদিকদের সঙ্গে চোখচোখি হতেই সেই চেনা হাসি। সালাম ও সৌজন্যতা, বিনিময়।
আমি ক্রিকেটার। বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। বিপিএলে তিনবারের শিরোপা বিজয়ী দলের ক্যাপ্টেন। এবারো ফাইনালে পৌঁছে গেছি। এগুলো তার মাঝে ক্রিয়া করে না। তার ব্যক্তি ও বাহ্যিক আচারণে কখনো এসব ফুটেও ওঠে না। তাই তো ফাইনালের চব্বিশ ঘণ্টা আগে প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে বলতে পারেন এক সময় চিন্তাও করিনি ফাইনাল খেলবো। কিন্তু এখন খেলছেন, আর সেটা আপনার গতিশীল নেতৃত্ব ও চমৎকার পারফর্মেন্সে।ঈএমন প্রশ্ন শুনে যেন লজ্জাই পেল মাশরাফি। অবলিই বলে দিলেন সমস্ত কৃতিত্ব ক্রিকেটারদের। দেশি বেদেশি সবাই জান প্রাণ নিয়ে চেষ্টা করেছে তাই আমরা আজ ফাইনালে। এমন বিনয়ী সংলাপ শুধু মাশরাফির মধ্যেই শোভা পায়।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের কাছে মাশরাফি বড় ভাই, অভিভাবক। বড় নির্ভরতা ও স্বস্তির প্রতীক। ব্যক্তি জীবনে উদার বলেই তামিম, মুশফিক ও সাকিবের মত মাঠ মাতানো আর চারদিক আলোকিত করা পারফরমারও মাশরাফি ভাই বলতে অজ্ঞান।
Advertisement
সবাই জানেন, মাশরাফি যখন যে দলে খেলেন, সেই দলের ক্রিকেটার, কর্মকর্তা, কোচ ও ম্যানেজারের সঙ্গে আন্তরিকতা ও ভালোবাসার মিশেলে এক নিবিঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান। এবার যেমন রংপুর রাইডার্সকে গেঁথে ফেলেছেন এক সুঁতোয়। ক্রিস গেইল আর ব্রেন্ডন ম্যাককালামের মত বিশ্বসেরা ক্রিকেটাররাও অধিনায়ক মাশরাফির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তার নেতৃত্বগুণে মুগ্ধ।
বলার অপেক্ষা রাখে না মাশরাফির নেতৃত্ব ক্ষমতা, দলকে উজ্জীবিত ও উদ্বুদ্ধ করা এবং সহযোগীদের অনুপ্রেরণা জোগানো দেখে গেইল-ম্যাককালামের মত ‘মেগা’ স্টাররাও খুশি। তাই তো তাদের মুখে মাশরাফি বন্দনা। সহযোদ্ধাদের সাহস জোগানো ফর্মহীন পারফরমারকে ফর্মে ফেরাতে সাহস, আস্থা ও আত্ববিশ্বাসী করে তোলাই শেষ নয়। মাঠেও ‘ক্যাপ্টেন’ মাশরাফি দারুণ পারফরমার। সবার জানা বিপিএলেও অধিনায়ক মাশরাফি সবার সেরা।
বিপিএলের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মাশরাফি। প্রথম তিন আসরের চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক নড়াইলের সাহসী সেনাপতি। তার নেতৃত্বে ঢাকা গ্লাডিয়েটরস বিপিএলের প্রথম দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সও তৃতীয় বিপিএলে শেষ হাসি হাসে মাশরাফির হাত ধরেই। আর কোন অধিনায়কের এমন সাফল্য ও কীর্তি নেই। পর পর তিন বিপিএলের ফাইনালে প্রধান অতিথির হাত থেকে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নেয়া গর্বিত অধিনায়ক মাশরাফি শুধু গতবারই শেষ হাসি হাসতে পারেননি। তার নেতৃত্বে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ২০১৬ সালে শেষ চারে নাম লেখাতে পারেনি।
এবার দল পাল্টে নতুন শিবিরে মাশরাফি। রংপুর রাইডার্সের অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে ক্রিস গেইল, ব্র্যান্ডন ম্যাককালাম, লাসিথ মালিঙ্গা, জনসন চার্লস আর থিসারা পেরেরার মত ক্রিকেটাররা খেলছেন। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে মানে ঢাকা ক্লাব লিগ ও বিপিএলে তার নেতৃত্বে তিন-চার নম্বর দলের চ্যাম্পিয়ন হবার নজির আছে বেশ কিছু। যার নেতৃত্ব গুণে পাল্টে যায় দল। ভালো খেলতে দৃঢ় হয়ে ওঠে এক নম্বর হয়ে যায়।
এবার যেমন হয়েছে মাশরাফির রংপুর রাইডার্স। খুরিয়ে খুরিয়ে চার নম্বর হয়ে সেরা চারে জায়গা পাওয়া মাশরাফির দল এলিমিনেটরে এসেই দূর্বার। পর্যাপ্ত সামর্থ্য আর অসীম ক্ষমতা থাকার পরও যারা পুরো রবিন লিগে কিছুই করতে পারেননি, সেই ক্রিস গেইল আর ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ঠিক সময়মত জ্বলে উঠেছেন। খুলনার সঙ্গে ১২৬ রানের (৫১ বলে) ঝড়ো ইনিংস খেলে দলকে সাফল্যের পথ দেখিয়েছেন গেইল।
আর গতকাল সোমবার রাতে জনসন চার্লস (৬৩ বলে ১০৫) ও ম্যাককালামের (৪৬ বলে ৭৮) উত্তাল উইলোবাজিতে চূড়ান্ত সাফল্যের খুব কছে রংপুর। আর একটি মাত্র সিড়ি। তা পাড় হলেই মাশরাফির দল রংপুর পৌঁছে যাবে সাফল্যের চূড়ায়। গতবার না পারা মাশরাফি ১২ ডিসেম্বর রাতে হোম অফ ক্রিকেট শেরে বাংলায় আবার কাপ উঁচিয়ে হাসবেন শেষ হাসি। তা কি হবে? প্রথম ও একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে চার চার বারের শিরোপা জয়ী অধিনায়ক হতে পারবেন মাশরাফি?
এআরবি/এমআর/আরআইপি