ভ্রমণ

মালয়েশিয়ার বাতু কেভসে পর্যটকদের পদচারণা

কুয়ালালামপুর থেকে বাতু কেভস যাওয়া যায় ট্যাক্সি ক্যাব, বাস কিংবা ট্রেনে। খরচ বেশি লাগে ট্যাক্সিতে আর সবচেয়ে কম ট্রেনে। ট্যাক্সিতে প্রায় ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ রিঙ্গিত লাগে। সেখানে কমিউটার ট্রেনে ভাড়া মাত্র তিন রিঙ্গিত। পৃথিবীর আর কোথাও এত কম খরচে এত অত্যাধুনিক ট্রেন সার্ভিস আছে কিনা জানি না। পাসার সেনি থেকে ট্রেনে উঠে নামতে হয় যে স্টেশনে, সে স্টেশনের নামও বাতু কেভস। বোঝাই যাচ্ছে বাতু কেভস ঘিরেই এই স্টেশন। এই লাইনে এটাই শেষ স্টেশন। স্টেশন থেকে বের হলেই বাতু কেভস।

Advertisement

বাতু কেভস ব্যাপারটি কী? পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। কুয়ালালামপুরের দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে গুগলে সার্চ দিলে যে কয়েকটি জায়গার নাম আসে তার মধ্যে প্রথম দিকেই আছে বাতু কেভস। ছবিতে দেখা যায় বিশাল বিশাল পাহাড়। পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকৃতির, প্রায় পাহাড়সম এক সোনালি রঙের মূর্তি। মূর্তির পাশ দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি পথ। শত শত সিঁড়ি পথের শেষ মাথায় গুহামুখ। বাতু কেভসের এই ছবিটিই সবচেয়ে কমন। ছবিতে মূর্তির পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া সিঁড়ি পথের শেষে যে গুহামুখ, সেই গুহামুখের রহস্যময়তাই সবাইকে সেখানে টেনে নিয়ে যায়।

সোনালি রঙের ১৪০ ফুট উঁচু মুরুগান মূর্তি চুনাপাথরে তৈরি। এ পাহাড়ে ‘ভেল’ আকৃতির গুহামুখ দেখে আকৃষ্ট হয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ী থাম্বুসামী পিল্লাই মুরুগান দেবতাকে উত্সর্গ করে ১৮৯২ সালে মূর্তিটি তৈরি করেন। ভেল হচ্ছে মুরুগানের হাতের অস্ত্রসদৃশ দণ্ড। চব্বিশ মিলিয়ন রুপি খরচ করে কংক্রিট ও স্টিলবারে নির্মিত এই মূর্তিটি সোনালি রং করার জন্য স্বর্ণ থেকে তৈরি তিনশ’ লিটার স্বর্ণালি রং থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল। বাতু কেভস মূলত হিন্দুদের (তামিল ভাষাভাষি) ধর্মীয় তীর্থস্থান।

স্টেশন থেকে বের হতে মেইন গেটের বাম দিক দিয়ে একটা প্রবেশ পথ আছে। গেটটির চারপাশ খুবই নোংরা। সেখানে তামিল নারীরা প্লাস্টিক ক্লথ বিছিয়ে পায়েল-নূপুর জাতীয় দক্ষিণ ভারতীয় ডিজাইনের অলঙ্কার বিক্রি করেন। তামিল নারীদের গায়ে মলিন শাড়ি বা কাপড় আর সারা শরীর জড়ানো রূপা বা এ জাতীয় অলঙ্কারে। তাদের এ অলঙ্কার পশ্চিমা মেয়েদের আকর্ষণ করে বেশি। আমি এক ফর্সা, লম্বা, স্বাস্থ্যবান এক পশ্চিমা মেয়েকে দেখলাম, মাটিতে বসে পায়ে পায়েল মাপ দিয়ে দেখছে। পা নাড়িয়ে ঝুনঝুন শব্দ করছে।

Advertisement

বাতু কেভসের সীমানায় ঢোকার পর যা দেখা যাবে, তার অধিকাংশই বিশাল আকৃতির। বিশাল বিশাল আকাশ ছোঁয়া পাহাড়। তা-ও মাটির পাহাড় নয়, কঠিন পাথরের পাহাড়। মূল গেটের বাম দিক দিয়ে ঢুকলেই পড়বে বিশাল হনুমান দেবতার মূর্তি। একটি মন্দির পার হলেই মূল মূর্তি, মুরুগানে মূর্তি। তারপর দুইশ’ বাহাত্তর ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে গেলেই বিশাল গুহা।

মালয়েশিয়ায় মুসলমান মেয়েরা প্রায় সবাই মাথায় স্কার্ফ পরে। আর চাইনিজ, জাপানিজ, থাই, ফিলিপিনো মেয়েদের প্রায় সবাইকে শর্টস, মাক্রো মিনিতে দেখা যায়। তামিলদের গায়ের রঙের কারণেই বোধহয় শর্টস পরার উপায় নেই। কিন্তু বাতু কেভসে এর বিপরীত দৃশ্য দেখা যাবে। অধিকাংশ মেয়েকেই দেখা যাবে জর্জেটের ওড়নার মতো হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটা কাপড় কোমর থেকে প্যাঁচ দিয়ে পরে আছেন। এখানে এসে চাইনিজ, জাপানিজ মেয়েদের স্টাইল হঠাৎ করেই বদলে যায়। কারণ জানা গেল সিঁড়ির গোড়াতেই। সেখানে সাইন বোর্ডে লেখা আছে, এটি একটি ধর্মীয় উপাসনালয়। শর্টস পরিধান করে প্রবেশ নিষেধ। তার পাশেই তামিল মেয়েরা টেবিল পেতে বসে আছে। টেবিলের ওপর জর্জেটের ওড়না। এখান থেকে ওড়না কিনে শর্টস ঢাকলেই তবে ওপরে ওঠা যাবে। অধিকাংশই গুহা দেখার আকর্ষণে শর্টস ঢেকে ওড়না পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যতিক্রমও দেখেছি। এক মেয়েকে দেখলাম, বেশ কিছুক্ষণ সে তর্ক করে বোঝাতে চেষ্টা করল এটা যুক্তিহীন। শেষ পর্যন্ত সে আর উপরে ওঠেনি। তার পরিবারের সবাই গিয়েছে। সে রয়ে গেছে নিচে। সেখানেই ঘুরে বেরিয়েছে এবং ছবি তুলেছে।

২৭২টি সিঁড়ি পার হয়ে উপরে উঠলে মূলগুহা। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বানরের দল এসে ঘিরে ধরবে। ছোট ছোট বাচ্চা বানর থেকে শুরু করে বুড়ো বানর পর্যন্ত। এরা সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার সময় মানুষের ওপর দিয়েই ঝাপাঝাপি করে। খাবার দেখলে নিতে চায়। আমি যখন উঠছিলাম- তখন দেখলাম, তামিল এক নারীর হাতের পলিব্যাগে ফাস্ট ফুড ছিল। এক বানর এসে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। তামিলরা সাধারণত খুব সাহসী হয়, কিন্তু তিনি বানরের আকস্মিক আক্রমণে ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। বানররা শুধু খাবার দেখলেই হামলা করে ব্যপারটা তা নয়। মধ্যপ্রাচ্যের এক মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল। হঠাৎ এক বাচ্চা বানর এসে কোনো কারণ ছাড়াই তাকে খামচি মেরে চলে গেল। সে উপরে উঠে ভয়ে কাঁপছিল। তার সঙ্গে ছিল এক তামিল ছেলে।

সে দোকানদারদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল বানরের খামচিতে কিছু হবে কিনা। দোকানদাররা সম্ভবত না জেনেই উত্তর দিলো, ‘কিছু হবে না’। ওই ছেলে আমাকেও জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, ‘বানর খামচি দিলে কিছু না হলেও এরা কিন্তু বন্য বানর। পাহাড়ের বন থেকে এরা আসে। যদি এরা কোনো জলাতঙ্কবাহী প্রাণির কামড় খেয়ে থাকে তাহলে বিপদ হতে পারে।’ মেয়েটি ফ্যাকাশে মুখে বলল, ‘এখন আমি কী করব?’ আমি বললাম, ‘এখন ভীত হওয়ার কিছু নেই। তবে শহরে ফিরে গিয়েই ভ্যাকসিন নিতে হবে।’ এরপর আমি গুহামুখ দিয়ে গুহার ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

Advertisement

বাইরে থেকে পাহাড়টা যত বিশাল মনে হয়, ভেতরে গুহা তত বড় নয়। ইনকাদের মতো পুরো একটা কমিউনিটি বাস করতে পারবে। এখন বাস করছে তামিল ধর্মযাজকরা। পুরো এলাকাতেই তামিলদের আধিপত্য। গুহার মধ্যে যেতে হলে ভিতরে আবার সিঁড়ি ভেঙে নিচের দিকে নামতে হয়। চারদিকে দেব-দেবীর ছোট ছোট মূর্তি রহস্যময়ভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছে। গুহার ভেতর থেকে উপরের দিকে তাকালে ছোট ফোঁকর দিয়ে আকাশ দেখা যায়। বিপরীত দিকে আরেকটি মুখ আছে। সেখান দিয়ে বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। বনের মতো ঘন গাছপালা।

ধর্মীয় কারণে বাতু কেভসে সবসময় মানুষের পদচারণা। না হলে এই গুহাটি রয়ে যেত রহস্যঘেরা। যার রহস্যে মানুষ রোমাঞ্চিত হতো। অবশ্য এখনও হয়।

এসইউ/পিআর