পবিত্র ভূমি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে গত ৬ ডিসেম্বর ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ঘোষণার পর তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরেরও প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন তিনি।
Advertisement
ট্রাম্পের এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্তে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে। ট্রাম্পের সমালোচনা করছেন বিশ্বনেতারা।
সিরিয়া, মিসর ও জর্ডানের সঙ্গে যুদ্ধে ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে পূর্ব জেরুজালেম ইসরায়েলের দখলে চলে যায়। তার পর থেকেই পূর্ব জেরুজালেম নিয়ন্ত্রণ করে আসছে ইসরায়েল।
তবে জেরুজালেমে ইসরায়েলের মালিকানা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও এতদিন ইসরায়েলকে সেই স্বীকৃতি দেয়নি।
Advertisement
অন্যদিকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সমাধানের অন্যতম উপায় হলো জেরুজালেম। মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের কাছে জেরুজালেম অতি পবিত্র স্থান।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান
জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা ১৯৪৭ অনুযায়ী ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনকে ইহুদি এবং আরব সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। সেই সময় জেরুজালেমের বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয় এবং তাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণ থাকে।
তিনটি ধর্মের মানুষের আলাদা ধর্মের ধর্মীয় গুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে জেরুজালেমের এই বিশেষ সম্মান দেয়া হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের ফলে জাতিসংঘের সুপারিশ মেনে ফিলিস্তিন ভাগ করা হয়। ইহুদি সেনারা পশ্চিমের অর্ধেক এলাকা দখলে নিয়ে নিজেদের রাজ্যের এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেয়।
Advertisement
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে জেরুজালেমের পূর্ব দিকের অর্ধেক এলাকা দখলে নেয় ইসরায়েল। ওই সময় এলাকাটি জর্ডানের দখলে ছিল। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সেখানে ইসরায়েলের আইন চাপানোর চেষ্টা চলতে থাকে।
১৯৮০ সালে এসে ‘জেরুজালেম আইন’ পাস করে ইসরায়েল। এছাড়া জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণাও দেয়। ১৯৮০ সালেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ৪৭৮ নামে একটি আইন পাস করে ইসরায়েলের ওই আইন বাতিল করে দেয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও পূর্ব জেরুজালেমকে অধিকৃত এলাকা হিসেবে গণ্য করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রছাড়া এযাবৎ বিশ্বের কোনো দেশই জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
ধারণা করা হচ্ছিল, অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেম ভবিষ্যতে স্বাধীন ফিলিস্তিনের রাজধানী হবে। এখন পর্যন্ত তেল আবিবে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস রয়েছে। যদিও কিছু দেশের কনস্যুলেট অফিস জেরুজালেমে রয়েছে।
জেরুজালেমের ফিলিস্তিনিরা
পূর্ব জেরুজালেম ইসরায়েলের দখলে থাকলেও ফিলিস্তিনিরা সেখানে বসবাস করে আসছে। সেখানে বসবাস করলেও এখনও নাগরিকত্ব পায়নি ফিলিস্তিনিরা।
পূর্ব জেরুজালেমের চার লাখ ২০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির স্থায়ী বসবাসের কার্ড রয়েছে। জার্তীয় পরিচয়পত্র ছাড়াই তাদের অনেকের জর্ডানের অস্থায়ী পাসপোর্ট রয়েছে।
পাসপোর্ট আছে বলে তারা জর্ডানের নাগরিকও নয়। তারা জর্ডানে কাজ করতে পারে, তবে সরকারি কোনো চাকরি পায় না এবং শিক্ষা ভাতাও মেলে না।
সেখানে বসবাসরত বিশাল এই জনগোষ্ঠী ইসরায়েলের নাগরিক নয়, জর্ডানের নয় এমনকি ফিলিস্তিনের নাগরিকও নয়। বলা চলে তারা রাজ্যহারা।
এইসব বাসিন্দাদের শরণার্থী হিসেবে বিবেচনা করে ইসরায়েল। সেখানে বসবাস করলেও এইসব মানুষদের অধিকার বলতে কিছু নেই; এমনকি সেখানে জন্ম নেয়া কারও সেই অধিকার নেই।
আবার কোনো ব্যক্তি যদি ওই এলাকার বাইরে কিছু সময় ধরে থাকে কিংবা অন্য দেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে এমনকি পশ্চিম তীরে গেলেও পূর্ব জেরুজালেমে বসবাস করার অধিকার হারানোর ঝুঁকি থাকে।
যদি কোনো ব্যক্তি প্রমাণ করতে না পারে যে, জীবনের বেশিরভাগ সময় ধরে তিনি সেখানে বসবাস করছেন এবং সেটা ধারাবাহিকভাবে, তাহলেও সেখানে বসবাস করার অধিকার হারানোর আশঙ্কা থাকে।
সেখানে বসবাসরতদের ভাড়ার চুক্তিপত্র, বেতনের রশিদসহ ডজনের বেশি নথিপত্র দেখাতে হয়। আর তাতে ব্যর্থ হলে ছেড়ে যেতে হয় পূর্ব জেরুজালেম।
অথচ বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে কোনো ইহুদি জন্ম নিলে সে ইসরায়েলের নাগরিক হতে পারবে এবং একই ধরনের সুবিধা পাবে। সেই ইসরায়েলই ১৯৬৭ সালে ১৪ হাজার ফিলিস্তিনির নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে।
ইসরায়েল চায়, শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে রাখবে। যেটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করে।
১৯৬৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলে ইহুদিদের জন্য এক ডজনের বেশি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ইসরায়েলি সেনা ও পুলিশের পাহারায় দুই রাখের বেশি ইহুদি পূর্ব জেরুজালেমে বসবাস করছে।
অথচ ইসরায়েলে দাবি, জেরুজালেম তাদের অবিভক্ত রাজধানী। সেখানে যারা বসবাস করছে তারা আলাদা কেউ নেই। যদিও ফিলিস্তিনিরা শর্তসাপেক্ষে বসবাস করলেও ইহুদিরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। এটাই চরম বাস্তবতা।
সূত্র : আল জাজিরা
কেএ/আরআইপি