আন্তর্জাতিক

এপির অনুসন্ধান: ধর্ষণ থেকে রেহাই মেলেনি ৯ বছরের রোহিঙ্গা শিশুরও

গত জুনে পশ্চিম মিয়ানমারে নিজ বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন এক নবদম্পতি। মুহূর্তের মধ্যেই তাদের ঘুম ভেঙে যায় সাত সেনা সদস্যের উপস্থিতির কারণে। কোনো ধরনের সংকেত দেয়া ছাড়াই আচমকাই তাদের ঘরে ঢুকে পড়ে সেনাসদস্যরা।

Advertisement

সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা ওই দম্পতি নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়ে বার্তাসংস্থা এপির কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পদ্ধতিগত ধর্ষণ ও নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন। নববিবাহিত কনের নামের আদ্যক্ষর ‘ফ’। তিনি জানতেন মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে হামলা চালাচ্ছে।

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী জাতিগত নিধন অভিযান পরিচালনা করছে বলে জাতিসংঘ অভিযোগ করছে। মাত্র কয়েকদিন আগেই তিনি জানতে পান, সেনাবাহিনীর সদস্যরা তার বাবা-মা’কে হত্যা করেছে এবং তার ভাই নিখোঁজ রয়েছে।

এখন তারা তার কাছে এসেছে। সেনাসদস্যরা তার স্বামীকে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। পরে মাথা থেকে স্কার্ফ ছিনিয়ে নিয়ে তার মুখ বাঁধে। তার গয়না খুলে নেয়, খুলে ফেলে শরীরের কাপড়। তারা তাকে মেঝেতে ছুড়ে মারে। এরপরই প্রথম এক সেনাসদস্য তাকে ধর্ষণ করে।

Advertisement

তার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন কিন্তু অপর চার সেনাসদস্য তার মাটিতে চেপে ধরে রাখে এবং লাঠি দিয়ে মারপিট করে। ব্যথায় কাতড় দৃষ্টি নিয়ে তাকান স্বামীর দিকে; যিনি পেছনে অসহায় অবস্থায় বাঁধা রয়েছেন রশিতে। শেষ পর্যন্ত মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হন তিনি এবং চিৎকার করেন।

এরপরই তিনি দেখেন এক সেনাসদস্য তার স্বামীর বুক বরাবর বুলেট ছুড়েছে; যাকে মাত্র একমাস আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি। অপর এক সেনাসদস্য তার গলা কাটে। তার মন বেদনার বিষে নীল হয়ে যায়। সেনাসদস্যরা তাকে নগ্ন অবস্থায় বাড়ির বাইরে ফেলে রেখে যাওয়ার সময় তার বাশের তৈরি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।

ঘটনার দুই মাস পরে তিনি বুঝতে পারেন গর্ভে সন্তান এসেছে তার। রোহিঙ্গাদের নারীদের ধর্ষণে মিয়ানমার নিরাপত্তাবাহিনীর সুদূরপ্রসারী ও পদ্ধতিগত পরিকল্পনার প্রমাণ পেয়েছে বার্তাসংস্থা এপি। প্রতিবেশি বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের মধ্যে অন্তত ২৯ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে এপি।

যৌন হয়রানি থেকে বেঁচে এই রোহিঙ্গা নারীদের বাংলাদেশের কয়েকটি শরণার্থী শিবিরে পৃথক ও ব্যাপক পরিসরে সাক্ষারকার নিয়েছে এই সংবাদসংস্থাটি। তাদের প্রত্যেকের বয় ১৩ থেকে ৩৫ বছর; যারা মিয়ানমারের রাখাইনের বিভিন্ন গ্রাম থেকে গত বছরের অক্টাবর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝের দিকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।

Advertisement

রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইনে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় এই নারীদের অভিযোগের ব্যাপারে সত্যতা যাচাই করতে পারেনি এপি। তবে ধর্ষকদের ইউনিফর্ম, পোশাক ও ধর্ষণের ধরণ সম্পর্কে তাদের সবার গল্পগুলো প্রায়ই একই রকমের।

জাতিসংঘ বলছে, রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়া করতে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী ধর্ষণকে পদ্ধতিগত সন্ত্রাসের উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে এসব অভিযোগের ব্যাপারে মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর মন্তব্যের জন্য এপি বহুবার যোগাযোগ করলেও কোনো সাড়া পায়নি। গত মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ এক তদন্ত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, রাখাইনে কোনো ধরনের নিপীড়নের ঘটনা ঘটেনি।

কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সরকারের আমন্ত্রণে রাখাইন সফরে গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাখাইনের সীমান্ত কল্যাণ মন্ত্রী ফোন টিন্ট বলেন, ‘এই নারীরা দাবি করছেন, তারা ধর্ষিত হয়েছেন; কিন্তু তাদের শরীরের দিকে তাকান- আপনি কী মনে করেন, ধর্ষিত হওয়ার মতো তাদের শারীরিক আকর্ষণ আছে?

চিকিৎসক ও দাতব্য কর্মীরা বলছেন, ধর্ষণের শিকার নারীদের যে চিত্র তারা পেয়েছেন তাতে বিস্মিত। ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের খুব কম সংখ্যকই চিকিৎসার জন্য আসছেন। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা মেডিসিনস স্যানস ফ্রন্টিয়ারসের চিকিৎসকরা আগস্টের পর থেকে কক্সবাজারে ১১৩ জনকে যৌন সহিংসতার চিকিৎসা দিয়েছেন; যাদের এক তৃতীয়াংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তবে সবচেয়ে কম বয়সী ধর্ষণের শিকার শিশুর বয়স ৯ বছর। __

সংকটকালীন প্রতিবেদন নিয়ে পুলিৎজার সেন্টারের অর্থায়নে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেছে এপি।

বিশ্বে সবচেয়ে বঞ্চিত ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করেছে জাতিসংঘ; দেশটিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নেই, নেই কোনো মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের কক্সবাজারের তৃণভূমিতে জীর্ন-শীর্ণ শিবিরে বর্তমানে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।

এপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রত্যেক নারীই কালো-সবুজ রঙয়ের ইউনিফর্ম পরা সেনাসদস্য অথবা মুখোশ পরিহিতদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তবে শুধুমাত্র একজন নারী বলছেন, তাকে সাদা পোশাকে স্থানীয় এক প্রতিবেশি ধর্ষণ করেছে।

ধর্ষণ ও হামলার ব্যাপারে অন্য নারীদের দেয়া তথ্যও বর্ণনার সঙ্গে এফ’র বর্ণনা প্রায় একই। কয়েকজন বলেছেন, নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা গ্রাম ঘিরে ফেলে, পুরুষদের থেকে নারীদের আলাদা করে। পরে অন্য কোনো স্থানে নিয়ে গণধর্ষণ করে নারীদের।

এই নারীরা বলছেন, তাদের চোখের সামনেই স্বামীকে পিটিয়ে ও গুলি করে এবং সন্তানদের গলাকেটে গত্যা করতে দেখেছেন। রাতের আঁধারে প্রিয়জনদের মাটিচাপা দিয়েছেন; এমনকি অনেকের মরদেহ সেখানে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তারা ধর্ষণের নিদারুণ ব্যথার কথা বলছেন, রক্তপাত নিয়েই বাংলাদেশে এসেছেন দীর্ঘ পথ পায়ে মাড়িয়ে।

ধর্ষণ থেকে বেঁচে এসেছেন রোহিঙ্গা নারী ‘এন’। কিন্তু তার স্বামী, দেশ, শান্তি বলে কোনো কিছুই নেই এখন। তার করারও কিছু নেই; তবে তার আশা, তাদের দুর্দশার কথা হয়তো কেউ শুনবেন।

‘আমার আর কিছুই নেই। এখন বলা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই।’ সেনা পোশাকে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা এফ’র কাছে সন্ধ্যার পর এলেও ‘কে’র কাছে এসেছে দিনের আলোতে। তিনি বলেন, এটা ছিল আগস্টের শেষের দিকের ঘটনা। উত্তর রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পরের ঘটনা। নিরাপত্তাবাহিনী রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার জবাব দিয়েছে নৃশংস উপায়ে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, রাখাইনে শত শত রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।

বাড়িতে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে সকালের নাস্তার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ‘কে’। তারা কেবলমাত্র একবার ভাত মুখে তুলে দিয়েছেন; যখন তাদের গ্রামে রব পড়ে যায়: সেনাবাহিনী আসছে। তার তিন সন্তান ও স্বামী পাশের একটি পাহাড়ে গিয়ে আত্মগোপন করেন। ‘কে’ ছিলেন ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ফোলা পায়ে হাটতে পারছিলেন না তিনি। সুতরাং কী করবেন তা ভাবার কোনো সময় ছিল না, লুকানোর কোনো স্থান ছিল না।

দরজা খুলে ঘরে ঢুকে পরে সেনাসদস্যরা। তিনি বলেন, চার থেকে পাঁচজন হবে, ইউনিফর্ম পরা। তার ছোট ছেলে ও মেয়ে কাঁদতে শুরু করেন। পরে নির্দয়ভাবে তাদের দরজা দিয়ে বাইরে ছুড়ে মারা হয়। অন্তঃসত্ত্বা হলেও তার প্রতি কোনো দয়া হয়নি তাদের। তাকে ধরে নিয়ে বিছানার ওপর আঁছড়ে ফেলা হয়। তার কান, গলা ও নাকের অলঙ্কার খুলে ফেলা হয়।

কয়েকদিন আগে গরু বিক্রির অর্থ ব্লাউজের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন; কিন্তু সেখানেও চলে যায় তাদের হাত। তার কাপড়-চোপড় খুলে হাত-পা রশিতে শক্ত করে বাঁধা হয়। বাধা দিতে গেলেই তাকে মারপিট করা হয়। পরে তাকে ধর্ষণ করতে শুরু করে তারা।

নড়াচড়ার চেষ্টা করছিলেন ‘কে’। কিন্তু একজন তার চোখের সামনে ছুরি ও অপর একজন বুকে বুন্দক তাক করে রাখে। অন্যজন তাকে ধর্ষণ করে। প্রথম জনের শেষ হওয়ার পর আবারও তার ওপর শুরু হয় নিপীড়ন। দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবেই চলে গণধর্ষণ।

৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা কে’র রক্তপাত শুরু হয়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান ফেরার পর তিনি দেখতে পান তার চাচীরা কাঁদছেন। বয়স্করা তাকে গোসলের পর কাপড় পরিয়ে দিচ্ছেন। তার স্বামী বাড়িতে ফেরার পর রেগে যায়: স্ত্রীকে যারা ধর্ষণ করেছে তাদের জন্য নয়; বরং তার স্ত্রীর ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন; কেন তিনি চাওয়ার পরও পালায়নি।

তিনি গর্ভবর্তী ছিলেন, পালানোর কোনো উপায় ছি না। তার পেছনে গুলি চালানো হয়েছিল। কিন্তু তারপরও স্বামী তাকে তালাক দেয়ার হুমকি দেন; কারণ তাকে ধর্ষণ করেছে একজন অমুসলিম। (সংক্ষেপিত)

সূত্র: এপি।

এসআইএস/পিআর