গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী রামদিয়া বন্দর ঘেঁষা বলুগা নদী অবৈধ দখলের কারণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। দিনের পর দিন নদীর দুই পাড় ও নদী জুড়ে পাকা স্থাপনা, আবাসিক ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে দখলদাররা নদী দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এছাড়া নদীর মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে মাছের ঘের, কাঠা ও বানা দিয়ে মাছ চাষ করে দখলদাররা পুরো নদীটিই দখল করে চলছেন। দখল ও নাব্যতা সঙ্কটসহ নানা কারণে নদীটির অস্তিত্ব এখন বিপন্ন।এক সময় এ নদীটি ছিল রামদিয়া বাজার বন্দরের প্রাণ। শত শত পণ্যবাহী নৌকা, লঞ্চ ও নৌযান চলাচল করতো এ নদী দিয়ে। দূর দূরান্তের ব্যবসায়িরা তাদের মাল পরিবহনের পথ হিসেবে ব্যবহার করতেন এ নদী। খুলনা, টেকেরহাট, ঝালকাঠি, চরমুগরিয়া, মীরকাদিম, লৌহজং প্রভৃতি স্থানের পাট ও চাল ব্যবসায়িরা এ নদী দিয়ে পরিবহন করে এলাকার মানুষের চাহিদা মেটাতেন। বড় বড় মহাজনি নৌকায় ধানের বেঁচা-কেনা হতো নদীর পাড় ঘেঁষে। এখন আর সেই ঐতিহ্য নেই। বলা চলে নদীটি এখন মৃত। অবৈধ দখলদারদের নদী দখলের কারণে সাধারণের পানি ব্যবহারের সুযোগ পর্যন্ত এ নদীতে নেই। নদী দখলের প্রতিরোধে কেউ এগিয়ে আসছেন না। যেন দেখার কেউ নেই। নদীটি পুনঃখনন ও অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য সরকারিভাবে কোনাে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। অপরদিকে, রামদিয়া বাজারের উত্তর পাশে সরকারি খাদ্যগুদাম সংলগ্ন এলাকায় সরকারি জায়গা এবং খাল দখল ও ভরাট করে একটি মহল স্থায়ীভাবে দোকানপাট নির্মাণ করে ভাড়া দিচ্ছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিত্যক্ত কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি জবর দখল করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে দোকানপাট, বসতবাড়ি, বহুতল ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। একের পর এক সরকারি জায়গা দখল হলেও কর্তৃপক্ষ রহস্যজনকভাবে নীরবতা পালন করছেন।কয়েক বছর ধরে কচুরীপানায় ভর্তি রয়েছে বলুগা নদীর অধিকাংশ। ফলে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নদী তীরবর্তী হাজার হাজার মানুষ। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই কচুরীপানায় আটকে গেছে নদীর শরীর। ইরি-বোরো মৌসুমে এ অঞ্চলের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল কেটে বাড়ি তুলতে চরম ভোগান্তির শিকার হন। তালতলা ব্রিজ থেকে আড়ুয়াকান্দি ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার জুড়ে কচুরীপানায় ভরে আছে। বড় নৌকা ও ট্রলার ঢুকতে পারে না। এসব অবস্থার জন্য কাশিয়ানী উপজেলার রামদিয়া, নড়াইল, ধীরাইল আড়ুয়াকান্দি, তালতলা ও সাফলীডাঙ্গা এলাকার মানুষের কাছে বালুগা নদী এখন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীর সঙ্গে টেকেরহাট বন্দরের কুমারনদীর সংযোগ খাল মাদারীপুর বিলরুট ক্যানেল (এমবিআর) নামে পরিচিত। আর একই সঙ্গে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ভেড়ারহাট থেকে উৎপত্তি হয়ে রামদিয়ার মধ্যদিয়ে ফরিদপুরের চন্দনা বারাশিয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বলুগা নদী নাম ধারণ করে। যা ওয়াপদার খাল নামেও পরিচিত। আর এ নদীর কারণে রামদিয়ার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ফলে রামদিয়ায় গড়ে ওঠে জেলার অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং নৌবন্দর।এ বন্দর থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় ও দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে। ফলে বাণিজ্যিক কেন্দ্রটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। এমনকি নৌপথে ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকায় রামদিয়ায় দুটি সরকারি খাদ্য গুদাম নির্মিত হয়। নাব্যতা সঙ্কটের কারণে আজ সে খাদ্য গুদাম দুটোও অকার্য়কর হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ব্যাপারে এলাকার বিশিষ্ট সমাজ সেবক ডা. অসিত বরণ রায় জাগো নিউজকে জানান, অচিরেই নদীতে অবৈধভাবে নির্মিত স্থাপনা সরিয়ে ফেলে নদীকে দখলমুক্ত করতে হবে। পুনঃখনন করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। রামদিয়া বাজারের ব্যবসায়ী নির্মল বিশ্বাস জাগো নিউজকে জানান, নদীর মধ্যে বানা এবং বাঁশ পুতে নির্মিত মাছের ঘের, কাঠা অপসারণ ও কচুরিপানা সরিয়ে নিয়ে নদীর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা দরকার। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহল যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আমরা আশা করি। সাফলিডাঙ্গা গ্রামের এছেম মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, রামদিয়া বন্দরকে সচল করতে হলে বালুগা নদী দখলমুক্ত ও পুনঃখনন করার কোনো বিকল্প নেই। গোপালগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বালুগা নদী ও সংযোগ খাল পুনঃখননে স্কীম গ্রহণ করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুম শেষে কাজ শুরু হবে। নদী ও নদীর পাড় দখল করে স্থায়ী অবকাঠমো নির্মাণ করার ফলে এলাকার মানুষের উপর এর দীর্ঘমেয়াদী ও ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে। জনবল সঙ্কটের কারণে আমাদের পক্ষে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক কিছুই করা সম্ভব হয়না। এছাড়া নদী ও নদীর পাড় দখল অবৈধ দখল মুক্ত করার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। এ ব্যপারে জেলা প্রশাসক মো. খলিলুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ইতোপূর্বে দখল মুক্ত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবৈধ দখল মুক্ত করতে হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সিভিল সোসাইটির ভুমিকা জরুরি। এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে জনমত গঠন সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আমরা উদ্যোগ নেব।এস, এম, হুমায়ূন কবীর/এমজেড/এমআরআই
Advertisement