সোমবার, সকাল সাড়ে ৭টা। রাজধানীর আজিমপুর করবস্থান সংলগ্ন নতুন পল্টন লাইনের রাস্তা দিয়ে ধীর গতিতে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ।। বয়স আনুমানিক ৭০ থেকে ৭২ বছর। বয়সের ভারে ন্যুব্জ ওই বৃদ্ধের চুল-দাড়ি সবই পাকা।
Advertisement
তাকে ধীর গতিতে রিকশা টানতে দেখে পেছনে থাকা অন্য রিকশাচালকরা মহাবিরক্ত। অপেক্ষাকৃত এক তরুণ রিকশাচালক ওই বৃদ্ধকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, ‘টানতে পার না এই বুড়া বয়সে রিকশা চালানোর দরকারটা কী’?
এ কথা শুনে পেছনে ফিরে মুচকি হেসে বৃদ্ধ বললেন, বাবারে আমার মতো সব দাঁত পড়লে, শরীর কমজোর অইলে আপনেও তহন আস্তেই চালাইবেন। এ কথা বলে যথাসম্ভব জোরে রিকশার প্যাডেলে পা চালালেন তিনি।
বিজিবি তিন নম্বর গেটে এসে রিকশা থামিয়ে এক স্কুলছাত্রী ও তার মাকে নামিয়ে দিয়ে হাঁপাচ্ছিলেন। পরে রিকশাটা রাস্তার পাশে রেখে বিশ্রাম নিতে থাকলেন। শীতের সকালেও কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছিল তার। বৃদ্ধ ওই রিকশাচালককে দেখে পথচারীদের অনেককেই আফসোস করতে দেখা যায়।
Advertisement
কৌতুহলবশত এ প্রতিবেদক আলাপকালে ওই বৃদ্ধ রিকশাচালকের অব্যক্ত নানা কষ্টের কথা জানতে পারেন।
বৃদ্ধ ওই রিকশাচালকের নাম জলিলউদ্দিন মাতবর। শরিয়তপুর জেলার জাজিরা থানার জামাল মাতবরকান্দি গ্রামে বাড়ি । সংসারের চাকা সচল রাখতে গত ৩৮ বছর যাবত রাজধানীতে রিকশা চালাচ্ছেন। বর্তমানে লালবাগের শেখ সাহেব বাজারে থাকেন। চার ছেলে ও দুই মেয়েকে খাইয়ে পরিয়ে বড় করতে সারাজীবন কষ্ট করেছেন। বড় হয়ে চার ছেলে আয় রোজগার করবে, বৃদ্ধ বয়সে তাদের আয়ে একটু আরাম করবেন এমন ইচ্ছে থাকলেও ভাগ্য বিড়ম্বনায় তা হয়ে ওঠেনি।
প্রথমে বলতে ইতস্তত করলেও এক পর্যায়ে জলিল মাতবর যেন কষ্টের ঝাঁপি খুলে ধরেন। তিনি জানান, ছেলে মেয়ের মধ্যে ছোট ছেলেটি ছাড়া সবার বিয়ে দিয়েছেন। তিন ছেলে আয় রোজগার করলেও তারা বিয়েশাদি করে নিজেদের ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত; বাবা-মায়ের দিকে তাকানোর সময় নেই। টাকা পয়সা চাইলে উল্টো বলে, ‘যা কামাই করি তা দিয়া তো নিজেরাই চলতে পারি না, আপনাগো (বাবা-মা) কেমনে দিমু?’
বৃদ্ধ জানান, ছোট ছেলেটা অ্যামব্রয়েডারির দোকানে কাজ করতো। মাস দেড়েক আগে হোটেলে নাস্তা খেতে গেলে সেখান থেকে ছিনতাইকারী সন্দেহে পাশের টেবিলের তিন যুবকের সঙ্গে তার ছেলেকেও পুলিশ গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। বর্তমানে সে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। তাকে ছাড়াতে উকিল ২০ হাজার টাকা চেয়েছে। কিন্তু টাকার ব্যবস্থা না হওয়ায় ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে পারছেন না।
Advertisement
জলিল মাতবর আফসোসের সুরে বলেন, ‘পোলারা থাকতেও নাই। আমি রিকশা চালাইয়া বাপ-মারে খাওয়াইছি। দেশে যাওনের সময় বাপে শখ কইরা কী কী খায় তা কিন্না (কিনে) নিয়া মায়ের হাতে দিয়া কইছি আব্বারে খাওয়াও।’
‘মুরুব্বিরা কইতো বাপ-মায়েরে যে যেমন করবা তেমন ফল পাইবা। এইডা মিছা কথা, মানি না। ওই কথা সত্যি অইলে তো আর আমার আইজ রিকশা চালাইতে অইতো না।’
এখনতো ব্যাটারির রিকশা চলছে, তাহলে কষ্ট করে কেন প্যাডেলের রিকশা চালাচ্ছেন?- এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘ব্যাটারির গাড়ি তো নিষিদ্ধ। বুক উঁচাইয়া যেহানে খুশি সেহানে যাওন যায় না। এ কারণে কষ্ট অইলেও প্যাডেলের রিকশাই চালাই।
এমইউ/এমএমজেড/এনএফ/এমএস/জেআইএম