মতামত

‘ডাকসু নির্বাচন ইজ অ্যা মাস্ট’

‘ডাকসু নির্বাচন ইজ অ্যা মাস্ট। নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।’ এটি আমার কথা নয়। আপনার কথাও নয়। এটি রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি এডভোকেট আবদুল হামিদের, যিনি একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যও। তিনি এটি বলেছিলেন গত ৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে।

Advertisement

রাষ্ট্রপতি এবং আচার্যের এমন দৃঢ় অবস্থানের পর পেরিয়ে গেছে ৯ মাস সময়। এই সময়ে অনেককিছু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বদল হয়েছে, প্রশাসন বদলে গেছে, এক শিক্ষক আরেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, শিক্ষকরা ছাত্রদের মেরেছেন, শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছেন, গাঁজা খাওয়া নিয়ে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সাথে মারামারি হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি নিয়মিত রং সাইডে চলে। অনেক কিছু হলেও সবচেয়ে জরুরি কাজটি হয়নি, এমনকি আচার্যের নির্দেশের ৯ মাস পরও ডাকসু নির্বাচনের কোনো প্রস্তুতি নেই।

গত ২৭ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সময়ে সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি, সিন্ডিকেট সদস্য, ডিন, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনসহ সব সংগঠনের নির্বাচন নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে দরকারি ও আলোচিত নির্বাচনটিই হয়নি। ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশে ২০ ধারা অনুযায়ী, সিনেটের ১০৫ জন সদস্যের মধ্যে ৫ জন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকার কথা, যাদের ডাকসুর মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসার কথা। কিন্তু ২৭ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় খণ্ডিত সিনেট নিয়েই চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ ডাকসু নির্বাচনে অত লম্বা প্রস্তুতির কিছু নেইও। কারণ প্রতিবছর ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা।

যে নির্বাচন প্রতিবছর হওয়ার কথা। সে নির্বাচন ২৭ বছর ধরে হচ্ছে না। এমনকি রাষ্ট্রপতির নির্দেশের ৯ মাস পরও কোনো নড়াচড়া নেই। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আপনি পাবেন না। সরকারকে জিজ্ঞাসা করুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে জিজ্ঞাসা করুন, প্রক্টরকে জিজ্ঞাসা করুন, ছাত্রলীগের সভাপতিকে জিজ্ঞাসা করুন, ছাত্রদলের সভাপতি, বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাদের জিজ্ঞাসা করুন; সবাই আচার্যের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলবে- ডাকসু নির্বাচন ইজ অ্যা মাস্ট। কিন্তু নির্বাচন আর হবে না। আমার মাথাতেই ঢোকে না, সবাই যে নির্বাচনটি চায়, সে নির্বাচনটি হয় না কেন?

Advertisement

ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। ১৯৯৮ সালে ছাত্রদল নেতা আমান উল্লাহ আমান এবং খায়রুল কবির খোকনের নেতৃত্বাধীন সেই ডাকসু ভেঙে দেয়া হয়। তারপর থেকে কত প্রতিশ্রুতি, কত আন্দোলন, কত অঙ্গীকার। কিন্তু নির্বাচন আর হয় না। অথচ নব্বইয়ের ডিসেম্বরে এরশাদের পতন হয়েছিল গণতন্ত্র মুক্তির আকাঙ্খায়। কিন্তু ঘটেছে উল্টো ঘটনা। স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে ডাকসুতে দুইবার নির্বাচন হয়েছে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা জিয়াউর রহমানের আমলেও দুইবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। এমনকি বিচারপতি সাত্তারের স্বল্প মেয়াদেও একবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। স্বৈরাচারের পতনের পর গত ২৭ বছরে আওয়ামী লীগ তিন দফা, বিএনপি তিন দফা ক্ষমতায় ছিল এবং আছে। কেউই ডাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। স্বৈরাচার নিপাত গেছে, কিন্তু গণতন্ত্র আর মুক্তি পায়নি।

গত ২৭ বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ছাত্র রাজনীতি নির্বাসিত। এখন সেখানে বিরোধী মতের কোনো স্থান নেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ সর্বেসর্বা, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল। অথচ স্বৈরাচার আমলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মতের স্থান ছিল। তখন ভাগাভাগিটা এমন ছিল- উত্তর পাড়া মানে মহসিন, সূর্যসেন, জসীমউদদীন, বঙ্গবন্ধু, জিয়া হল ছাত্রদলের দখলে আর দক্ষিণপাড়া মানে জহুরুল হক, এস এম, জগন্নাথ, শহীদুল্লাহ হল ছিল ছাত্রলীগের ঘাঁটি। এখন আর কোনো ভারসাম্য নেই। তাই নেই, ছাত্রদের দাবি নিয়ে কোনো আন্দোলনও।

কিন্তু ন্যায্য দাবির যে শক্তি তা উপেক্ষার সুযোগ নেই কখনোই। বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ এটাকেই আমি গণতন্ত্রের শেষ কথা বলে মানি। একজনও যদি ন্যায্য কথা বলে, তা মানতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ অনুষদের সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্সের ছাত্র ওয়ালিদ আশরাফ ন্যায্য দাবি নিয়ে অনশন করে একাই কাঁপিয়ে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নিয়মিত ছাত্র না হলেও তিনি ছাত্রদের বেদনাটা ধারণ করতে পেরেছিলেন। ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবিতে টানা ১৫ দিন উপাচার্যের বাসভবনের সামনে টানা অনশন করেছেন।

ওয়ালিদ কোনো ছাত্র সংগঠনের সদস্য নন। কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেও তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি খালি বুঝতে পেরেছিলেন, ছাত্রদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য, জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন দরকার। তাই তিনি লড়ে গেছেন একাই। শুরুতে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার সংগ্রামকে পাত্তা দেননি। কিন্তু তার দাবির ন্যায্যতার কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশ্বাস দিয়েছেন। তার আশ্বাসেই অনশন ভেঙ্গেছেন ওয়ালিদ। তবে তারিখ ঘোষণা না করা পর্যন্ত নানা প্রতিবাদী কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। উপাচার্য ওয়ালিদকে কলা খাইয়ে অনশন ভাঙ্গিয়েছেন। এখন উপাচার্য তাকে কাঁচকলা দেখিয়ে না দিলেই হয়।

Advertisement

সব শাসকরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে ভয় পায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, এমনকি ওয়ান ইলাভেনের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদটা উঠেছিল এই ক্যাম্পাস থেকেই। তাই সব সরকারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। ডাকসু নির্বাচন দিয়ে ছাত্রসমাজকে দাবি আদায়ে সচেতন হতে দিতে চায় না।

কিন্তু একটা জিনিস সবার বোঝা দরকার, ন্যায্য দাবি কখনো চাপা দিয়ে রাখা যায় না। কোনো না কোনো ওয়ালিদ আশরাফরা একাই মাঠে নেমে পড়ে। আর জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনেও ডাকসু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। গত ২৭ বছরে নিয়মিত নির্বাচন হলে ২৭ জন ডাকসু ভিপি, ২৭ জন ডাকসু জিএস পেতো। যারা আমাদের ভবিষ্যৎ নেতা হতে পারতেন। তাই আচার্যের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলছি ‘‘ডাকসু নির্বাচন ইজ অ্যা মাস্ট’।

১০ ডিসেম্বর, ২০১৭probhash2000@gmail.com

এইচআর/এমএস