শনিবার, দুপুর আনুমানিক ১টা। রাজধানীর চাঁনখারপুলে নির্মিতব্য ৫শ’ শয্যার শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনে পায়চারি করছেন আনুমানিক ৭০ বছর বয়সী একজন প্রবীণ চিকিৎসক। মাথা উঁচু করে ছয়তলা বিশিষ্ট নির্মিতব্য এ ভবনের প্রবেশ গেট দিয়ে বারবার তাকাচ্ছিলেন। একটু পরেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ইনস্টিটিউটের নির্মাণকাজের অগ্রগতি দেখতে আসবেন।
Advertisement
ভবন নির্মাণের সার্বিক তত্ত্বাবধানকারী সেনাবাহিনীর লেফটেনেন্ট কর্নেল শাকিলকে কাছে ডেকে সার্বিক প্রস্তুতি ঠিক আছে কি-না জানতে চাইলেন এবং বললেন, লিফটে দোতলায় ওঠার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়কে আপনি কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে ব্রিফ করবেন। এ সময় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হলে তিনি হেসে বলেন, বার্ন ইনস্টিটিউটের উদ্বোধন দেখে যেতে পারবো তো? উদ্বোধন দেখে মরলে আত্মা শান্তি পাবে।
প্রবীণ এ চিকিৎসকের নাম ডা. সামন্তলাল সেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সাধারণ দিনমজুর সবার কাছেই পোড়া রোগীদের পরমবন্ধু হিসেবে সুপরিচিত ডা. সেন। বিভিন্ন ধরনের পোড়া রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ডাক্তার, নার্সসহ প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তুলতে গত ৩২ বছর ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
একটু চেষ্টা করলে অনায়াসেই তিনি অধ্যাপক হতে পারতেন। কিন্তু তা করতে গেলে সরকারি চাকরির শর্তানুযায়ী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বদলি হতে হতো। তাই কখনই ন্যূনতম সে চেষ্টা করেননি। শুধুমাত্র পোড়া রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে একজন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জন হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (ঢামেক) বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে পেশাগত জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। আর এ কারণেই নিজে অধ্যাপক না হয়েও বহু অধ্যাপকের কাছে স্যার তিনি। নিজ কর্মগুণে নিজেকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন।
Advertisement
কয়েক বছর আগে সরকারি চাকরির মেয়াদ শেষ হলে অবসরে যান। এরপর কয়েকবছর চুক্তিভিত্তিক চাকরি করেন। চুক্তিভিত্তিক চাকরির মেয়াদ শেষ হলে শুধুমাত্র পোড়া রোগীদের মায়ার টানে প্রতিদিন হাসপাতালে ছুটে আসতেন। কেউ কেউ আড়ালে সমালোচনার সুরে বলতেন, চাকরি নেই তবুও কেন যে তিনি হাসপাতালে আসেন?
বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদের শেষ সময়ে বিএনপি-জামায়াতের পেট্রলবোমার ধ্বংসযজ্ঞে আহত হয়ে বহু রোগী ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহতদের দেখতে এসে জানতে পারেন পোড়া রোগীদের পরমবন্ধু ডা. সেনের চাকরি নেই তবুও তিনি প্রতিদিন হাসপাতালে ছুটে আসেন। এ কথা জানতে পেরে তিনি ডা. সেনকে সারাদেশে বার্ন ইউনিট স্থাপন জাতীয় প্রকল্পের সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ দেন এবং পোড়া রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে একটি বার্ন ইনস্টিটিউট স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে পূর্বপরিচিতির সূত্র ধরে ডা. সামন্ত লাল সেন স্মৃতিচারণ করে জানান, ১৯৮৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগদান করেন। ওই সময় হাসপাতালের দোতলায় মাত্র ৮ শয্যার ওয়ার্ডে বার্ন ইউনিটে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সরকারের আমলে তিনিসহ অনেকের প্রচেষ্টায় ঢামেকের বস্তিঘর এলাকা থেকে ধীরে ধীরে বর্তমান ১০০ শয্যার ঢামেক বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্তী এটিকে দেড়শ শয্যায় উন্নীত করা হয়।
তিনি জানান, দেশে প্রতি বছর প্রায় ছয় লাখ নারী, পুরুষ ও শিশু দগ্ধ হয়। তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে দেড় সহস্রাধিক বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জন প্রয়োজন হলেও বর্তমানে একশ বিশেষজ্ঞও নেই। আর তাই ডা. সেন এখনও অতৃপ্ত। তিনি স্বপ্ন দেখেন প্রায় পাঁচশ কোটি টাকা ব্যয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে শুধু পোড়া রোগীদের সুচিকিৎসাই হচ্ছে না, এ ইনস্টিটিউটে সারাদেশের পোড়া রোগীদের সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি হচ্ছে।
Advertisement
শনিবার নির্মিতব্য ইনস্টিটিউট পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গণমাধ্যমে জানান, আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে যে কোনো দিন উদ্বোধন হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের।
ডা. সেন জানান, পোড়া রোগীদের দীর্ঘসময় ধরে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। তারা নিদারুণ শারীরিক ও মানসিক কষ্টে ভোগেন। তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারলে তিনি ভীষণ আনন্দ পান। রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় কেউ আনন্দে কেঁদে ফেলেন, কেউ পায়ে ধরে সালাম করে আশীর্বাদ নেন। এটাই তার বড় পাওয়া।
১৯৪৯ সালের ২৪ নভেম্বর সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার ওসমানীনগর গ্রামে জন্ম ডা. সেনের। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৮০ সালে তৎকালীন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন তিনি।
ডা. সামন্তলাল সেন জানান, যুদ্ধপরবর্তীকালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুচিকিৎসা দিতে এদেশে এসেছিলেন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জন ডা. আর জে গাস্ট। মূলত তার হাত ধরেই এ অঙ্গণে প্রবেশ। ১৯৮১ সালে তিনি অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে ডিপ্লোমা ইন স্পেশালাইজড সার্জারি ডিগ্রি লাভ করেন।
ডা. সেন এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। মেয়ে নবনীতা সেন প্রবাসী। ছেলে অনাবিল সেন তার মতো পেশায় চিকিৎসক। দেশে একটি পোড়া রোগীও যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যান এটাই তার শেষ ইচ্ছা বলে জানান ডা. সেন।
এমইউ/বিএ/আইআই