শব্দটি আপাত শ্রুতিমধুর মনে হলেও রোগটি ভয়ঙ্কর- ম্যাসোকিজম। যতটা না শারীরিক, তারচেয়ে বেশি মানসিক। মানসিক ব্যাধি এটি। ধীরে ধীরে শরীরেও যায়। অনেকটা মনোদৈহিক। ম্যাসোকিস্টরা অত্যাচারিত হতে ভালোবাসে। নির্যাতনপ্রিয়। নির্যাতনকে, অত্যাচারকে এক সময় আর নিপীড়ন বলে মনে হয় না তাদের কাছে। সুখ পায়, স্বস্তিবোধ করে, আরাম উপভোগ করে নির্যাতনে। ব্যাধিটি ধীরে ধীরে বিকৃতিতে গিয়ে পৌঁছোয়। অত্যাচারিত, কিছুতেই অত্যাচারীকে ছাড়তে চায় না, চায় না ছেড়ে যেতে। অত্যাচারীর সঙ্গেই চায় জড়িয়ে থাকতে।
Advertisement
মনোবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েডের গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষদের চেয়ে নারীরা এ ব্যাধিতে ভোগে বেশি, আক্রান্ত বেশি হয়। প্রেমিকদের বা স্বামীদের অত্যাচারে এক ধরনের সুখ বোধ করে। পুরুষেরাও যে এ ব্যাধিতে একেবারেই ভোগে না অমন নয়। কখনও কখনও প্রেমিকা বা স্ত্রীর নির্যাতনকে মেনে নিতে নিতে, মানিয়ে নিতে নিতে একটা সময় উপভোগ করতে শুরু করে, ম্যাসোকিস্টরা যা হয়।
গত ক’দিন ধরেই অনলাইন মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শাকিব খান-অপু বিশ্বাসের ডিভোর্স নিয়ে রীতিমতো তোলপাড়। অপু বিশ্বাসের বেশ কটি সাক্ষাৎকার পড়লাম। সাক্ষাৎকার প্রায় সবকটি মোটের ওপর একই। ডিভোর্সের বিষয়ে প্রশ্ন, আর শাকিব খানের সঙ্গে সংসার করতে, সংসার টেকাতে, সংসার বাঁচাতে, অপু বিশ্বাসের মরিয়া হয়ে ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’- ধরনের চিৎকার। সবকটি সাক্ষাৎকার পড়ে অপু বিশ্বাসকে আমার ম্যাসোকিস্টই মনে হয়েছে।
মনে হয়েছে, দীর্ঘদিন অবজ্ঞা, অবহেলা, উপেক্ষা সয়ে সয়ে অপু বিশ্বাস এখন নির্যাতনকে, নিপীড়নকে ভালোবাসতে শুরু করেছেন। অসম্মানকে ভাবছেন সম্মান বলে। নিপীড়নকে আর নিপীড়ন বলে মনে হচ্ছে না তার। তার অবস্থা এখন ক্লিনিক্যাল। পারভার্ট ম্যাসোকিস্ট তিনি। ম্যাসোকিজমের পারভার্শন রীতিমত পেয়ে বসেছে তাকে। তিনি এখন কেবল মানসিক নির্যাতন নয়, শারীরিক নির্যাতনের অপেক্ষায় আছেন। ম্যাসোকিস্টদের যা হয়, শুরুতে মানসিক নির্যাতন সইতে সইতে, পরে শারীরিক নির্যাতনও ভালো লাগা শুরু হয়। আমি প্রায় নিশ্চিত, অপু বিশ্বাস এখন পারভার্ট ম্যাসোকিজমের ক্লিনিক্যাল লেভেলে আছেন।
Advertisement
তাই যদি না হয়, তবে যে স্বামী, স্ত্রীর পরিচয়কে গোপন রাখতে বলেন, ৮ বছরের দীর্ঘ দাম্পত্যকে লুকোতে চান, নিজের সন্তানের পরিচয়কে আড়ালে করেন, অস্বীকার করতে চান, সেই স্বামীর প্রতি অমন দুর্নিবার আকর্ষণ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না, থাকবার কথাও না। শাকিব খান যে বিবাহিত ক’দিন আগেও লোকে তা জানতো না, তার আব্রাম নামে যে এত বড় ছেলে রয়েছে তাও ছিল অগোচর। সন্তান বড় হচ্ছে, ক’দিন পর তাকে স্কুলে পাঠাতে হবে। সমাজে তার কী পরিচয় হবে, তার বাবা কে অমন অনেক প্রশ্নের মুখে অপু বিশ্বাস মুখ খুলতে, মিডিয়ার সামনে আসতে বাধ্য হন। সেই অপু বিশ্বাসকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ডিভোর্সের চিঠি পাঠান শাকিব খান।
নিজেকে যদি সম্মান না করি নিজে, কেউ করবে না আমাকে। নিজের প্রতি ব্যক্তির যে সম্মানবোধ সেটিই আত্মসম্মান। আত্মসম্মান যদি না থাকে নিজের, অন্যে আমাকে সম্মান করবে অমন ভাবনা ভুল। একে, ওকে, তাকে নয়; ভালোবাসতে হয় আগে নিজেকে নিজে। নিজের প্রতি ভালোবাসা নেই, সম্মান নেই- অমন মানুষের সর্বত্রই অসম্মানিত হবার সম্ভাবনা প্রবল। অপু হচ্ছেনও তাই। ঘরে-বাইরে।
দু’জন মানুষ যে কোনো মূল্যে এক ছাদের নিচে বসবাস ‘সংসার’, এ বড় ভুল ধারণা। একত্রবাস মানেই সুখবাস এমন নয় সবসময়। সহবাস কখনও কখনও দুঃসহবাসও হয়ে উঠতে পারে, হয়ে উঠতে পারে বিভীষিকাময়। দাম্পত্য আছে, প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই, সম্মান নেই এমন পরিস্থিতি আসলে সংসার নয় কারাগার, নিপীড়ন কারাগার। কে বলেছে কেবল স্বামীর স্ত্রী, স্ত্রীর স্বামী থাকলেই তার নাম সংসার। ভুল, খুব ভুলের মধ্যে বসবাস। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদের যে জায়গায় দুনিয়া পৌঁছেছে, তাতে প্রতিটি ব্যক্তি নিজেই তো তার সংসার। স্বস্তি নেই, আনন্দ নেই, মানসিক যন্ত্রণা আছে, নিপীড়ন আছে, উৎপীড়ন আছে অথচ তাকে সংসার ভাবা নেহাত বেকামি ছাড়া আর কি হতে পারে?
বলতে বাধ্য হচ্ছি, ডিভোর্স হলে শাকিব খানের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন অমন কোন ভাবনা কি তাড়িত করছে ভেতরে ভেতরে অপুকে? তাই যদি না হবে, তবে বড় হিরোর স্ত্রী অমন পরিচয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা কেন? খ্যাতি, সুনাম, সম্মান অপুর তো নিজেও আছে? অপুর সাহস নেই, অমনও মনে হয়নি আমার এ ঘটনার বিশ্লেষণে। বাড়ির অমতে বিয়ে করতে, নিজের ধর্ম পাল্টাতে যথেষ্ট সাহস লাগে, সে সবই তো করেছেন অপু বিশ্বাস- প্রয়োজনে।
Advertisement
যে প্রেমের কথা অপু বলছেন, তা আদৌ প্রেম কি? প্রেম তো কোন রেজিস্ট্রি করা দলিল নয়। হয়তো প্রেমটি ছিল, এখন নেই। আমি ভালোবাসি, বাসে না সে। আবার সে ভালোবাসে আমায়, আমি বাসি না তাকে- সেটিও প্রেম নয়। প্রেম তো ওয়ানওয়ে নয় বোথওয়ে, দুজন দুজনকে ভালোবাসলে, বিশ্বাস করলে, সম্মান করলে- নয়তো নয়। যাকে ভালোবাসে মানুষ তার চরিত্রহনন করতে পারেন না কখনওই। শাকিব খান ‘বয়ফ্রেন্ড’, ‘পরপুরুষ’, ‘পরকীয়া’ এসব বলতেও ছাড়েননি, স্ত্রী অপু বিশ্বাসকে।
বিয়ে অপু বিশ্বাসকে কিছুই দেয়নি, কেবল হারিয়েছেন তিনি। অর্জন নেই, শুধু বিসর্জন। নিজের পেশা, পরিচয়, সম্মান। এমনকি গর্ভের সন্তান। তিনবার গর্ভপাতও করতে হয়েছে তাকে অন্যের ইচ্ছেয়। শুধু বিয়ে কেন, স্ত্রী স্বামী কেন, যে কোনো সম্পর্কের মানবিক ভারসাম্য যদি না থাকে, সে সম্পর্ক তখন আর সম্পর্ক থাকে না।
আমাদের মেয়েরা পুরুষতন্ত্রের ছায়ার নিচে দীর্ঘকাল বসবাস করতে করতে শেকল, শৃঙ্খলাকেই নিরাপদ মনে করে। ভুগতে ভুগতে দুর্ভোগকেই উপভোগ করতে শুরু করে। নিশ্চিত থাকা খাওয়ায় অনেক কয়েদির যেমন মায়াজন্মে যায় জেলখানার প্রতি। হঠাৎ মুক্ত আলো বাতাসে আসতে ভয় পায়, ভাবে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে। আমাদের মেয়েদের অবস্থাও অনেকটা তাই। অভিনেত্রী হোক বা মেথরানি হোক, আইনজীবী হোক বা আয়া হোক, চিকিৎসক হোক বা চাকরানি হোক- বেশির ভাগ মেয়েদের আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মানের অবস্থাটা একই।
অপু বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। অপু, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হয়। কোথায় যেন পড়েছিলাম- ‘কে আছে আমি ছাড়া আমাকে বাঁচায়’। কথাটি আগুনের মতো সত্য। বাঁচতে হয়, বাঁচতে হয় নিজেকে নিজেই, অন্য কেউ নয়।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/পিআর