মতামত

পথ-নৈরাজ্যের অবসান হোক

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার হাইকোর্ট প্রদত্ত আদেশটি বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার নামে যে পথ নৈরাজ্য হয় তার অবসানে বড় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মোটরযান অধ্যাদেশ অনুসারে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে দায়ের করা কোনো মামলা আইনি প্রক্রিয়ায় এই প্রথম হাইকোর্টে সরাসরি নিষ্পত্তি হল। মামলাটি দায়ের করেছিলেন তারেক মাসুদের পরিবারের সদস্যরা। আদালতের রায়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে ক্ষতিপূরণের এ টাকা সংশ্লিষ্ট বাস মালিক, চালক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে পরিশোধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষও দুর্ঘটনায় তাদের স্বজন নিহত হলে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে উৎসাহিত হবে।

Advertisement

শুধু বেপরোয়া ড্রাইভিং, সড়কের বেহাল দশা, অদক্ষ চালক বা রেষারেষিই নয়, পথ-নৈরাজ্যের পেছনে বড় কারণের একটি হলো বিচারহীনতা। বাংলাদেশের পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক উভয়েই নিজেদের সব ধরনের আইনী পদক্ষেপের বাইরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে পেশি শক্তির জোরে। এমন এক প্রেক্ষাপটে এই রায়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমরা বরাবর দেখেছি পরিবহন খাতের পেশিশক্তিসম্পন্ন মালিক-শ্রমিকরা তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনে পারদর্শী। এরশাদ জামানায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করে রাজপথে যেমন ইচ্ছা তেমন করার অধিকার আদায়ের পর আদালতের রায়কেও তারা পরোয়া করেনি। কিছুদিন আগে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে বহনকারী মাইক্রোবাসকে চাপা দেওয়া বাসচালক জামির হোসেনের যাবজ্জীবন সাজা দেয়ায় অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছিল এরা। সাভারে ২০০৩ সালে ট্রাক চাপা দিয়ে খোদেজা বেগম নামের এক নারীকে হত্যা মামলায় চালকের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশের বিরুদ্ধে গিয়েও সারাদেশে পরিবহন শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করেছিল।

দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। সড়ক যোগাযোগ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই যে নৈরাজ্য চলছে, তাতে দুর্ঘটনাই হয়ে গেছে নিয়মিত বিষয়। স্বীকার উপায় নেই যে, সড়ক দুর্ঘটনা এবং তাতে হতাহতের বাস্তবতাই এখন স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো নিরাপদ ভ্রমণ। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুহীন একটি দিনও নেই এখন।

মহাসড়ক থেকে শুরু করে নগরের সড়কগুলো, বিশেষত ঢাকা মহানগরের সড়কের দিকে তাকালে মনে হয় না যে এখানে কোনও পরিকল্পনা কাজ করছে। সড়কের তুলনায় অতিরিক্ত যানবাহন, অনুপযোগী পথঘাট, আর দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা মিলিয়ে এক দুর্বিষহ অবস্থা। সরকারি হিসাবে বছরে প্রায় তিন হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তবে সব মৃত্যুর কারণ হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনা নিবন্ধিত না হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। যানবাহনের তুলনায় বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার পৃথিবীর মধ্যে প্রায় শীর্ষে।

Advertisement

ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, যানবাহন, অদক্ষ চালকসহ অনেক কারণ আমরা জানি। কিছু হয়তো ব্যবস্থার কথাও সরকার ভাবছে। কিন্তু পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটবে কী? এ দেশের সবচেয়ে উচ্ছৃঙ্খল খাত পরিবহন খাত। কিছুই বলা যায় না এদের। এরা মানুষ মারবে, পুলিশ ধরলে ধর্মঘট ডাকবে। এরা বিচারের ঊর্ধ্বে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকুক, এ খাতের শ্রমিক ইউনিয়ন বা মালিক সমিতির কর্তারা থাকেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। ক্ষমতায় এরা এমন অবস্থানে, যেকোনও দুর্ঘটনার এসব হত্যাকাণ্ডে শেষ পর্যন্ত ভিকটিমরাই আবারও ভিকটিম পরিণত হন। মানুষ নিরাপদ চলাচলের জন্য সড়কে নামে, কিন্তু তারা জানে না পথে পথে অপেক্ষা করছে খুনির দল।

সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশের কোনও বিচার হয় না। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষই বেশি দুর্ঘটনার শিকার হন। যারা পরিবহন মালিক তাদের আর্থিক শক্তি আছে। যারা শ্রমিক, তাদের পেশিশক্তি প্রশ্নাতীত। আর দরিদ্র মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভাববার সময় কোথায় আমাদের নীতি নির্ধারকদের? ফলে নৈরাজ্যই নিয়তি এই খাতে। পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতারা সরকারে থাকে, বিরোধী দলেও থাকে। পরিবহনের মালিকানায় আছে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনও।

এত-এত গাড়ি বাণিজ্য হয়, কিন্তু ড্রাইভার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের বড় অভাব। সরকারিভাবে অপ্রতুল। আর মানুষের রক্তচোষা লাভের টাকা ঘরে নিয়ে সম্পদের পাহাড় বানালেও, পরিবহন মালিকরা প্রশিক্ষিত দক্ষ চালক ও সহকারী তৈরির কোনও উদ্যোগ আজ পর্যন্ত নেয়নি। যোগাযোগব্যবস্থা মোটেও গণকেন্দ্রিক নয়। পুরো ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি। বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে জনগণের স্বার্থ পরাজিত। আদালতের পর্যবেক্ষণেও বলা হয়েছে - প্রতিটি জেলা জজ আদালতে একটি ট্রাইব্যুনাল থাকার কথা; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রতিনিয়ত যারা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন, তাদের স্বজনরা সেখানে গিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারছেন না।

এর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেনের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছিল আদালত। কিন্তু তার পরিবার একটি টাকাও পায়নি। সাংবাদিকের স্ত্রীকে নানাভাবে হয়রানি হজতে হচ্ছে এখনো। ১৯৮৯ সালে সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁর বিধবা স্ত্রী রওশন আখতার গত ২৬ বছরে যথাক্রমে বিচারিক আদালত, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়ে চূড়ান্তভাবে ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকার ডিক্রি লাভ করলেও, টাকা পাননি। বরং দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নে তাঁকে আবার নিম্ন আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। রওশন আখতার পদে পদে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে জীবন পাড়ি দিচ্ছেন। তারেক মাসুদের পরিবারেরও কি একই পরিণতি ভোগ করবে?

Advertisement

মানুষের কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্রের এখন কঠিন হওয়ার সময়। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর আইন প্রয়োজন। রায়ের বিরুদ্ধে মালিক শ্রমিকরা অবস্থান নিলে কঠোর হতে হবে সরকারকে। যখন-তখন যাত্রীদের জিম্মি করে অবৈধ সুবিধা আদায়ের সংস্কৃতি আর চলতে দেওয়া যায় না। নৈরাজ্য থেকে উত্তরণ চায় মানুষ। তবে তার জন্য সুশাসনের প্রয়োজন। আদালতের রায়ের আলোকে পরিবহন খাতে নতুন মূল্যবোধ এবং নতুন প্রশাসনবোধ তৈরি হোক।

লেখক : পরিচালক, বার্তা, একাত্তর টিভি। এইচআর/এমএস