বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি কাজ করলেও দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নির্বাচনমুখী হওয়া সবার মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ এ সচিবের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতি, অর্থনীতি, উন্নয়ন ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা নিয়ে মুখোমুখি হয় জাগো নিউজ। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও নির্বাচন নিয়ে কিছুটা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। দীর্ঘ আলোচনায় গুরুত্ব পায় রোহিঙ্গা ইস্যুও।
Advertisement
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজ’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারে আজ থাকছে প্রথম পর্ব-
জাগো নিউজ : নির্বাচনী হাওয়ায় ফের উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ। সব আলোচনা এখন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে। আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।
আকবর আলি খান : আমরা সংঘাতময় রাজনীতির মধ্যেই ছিলাম। এখনও সে পরিবেশ তিরোহিত হয়নি বলে মনে করি। তবে বড় দুটি দল থেকে নির্বাচনে আগ্রহ দেখানোর পর অন্তত কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এতে উভয় তরী উপকৃত হবে বলে মনে করি। আশা জাগিয়েছে দু’দলের নির্বাচনমুখী রাজনীতি।
Advertisement
জাগো নিউজ : সরকারপক্ষের তরী তো তীরেই আছে...
আকবর আলি খান : ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং পরে স্থানীয় নির্বাচনগুলো যথেষ্ট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ওই নির্বাচনগুলোতে স্বচ্ছতার অভাব ছিল, তা সরকারি দলও বিশ্বাস করে। এ প্রশ্ন থেকে সরকারি দলও মুক্তি চায়।
অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি যে ফল ভোগ করছে, তা থেকে দলটিও মুক্তি চায়। প্রশ্নবিদ্ধ রাজনীতি থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার জন্যই দুই দল নির্বাচন নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখাতে চাইছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসলে কী হবে, তা নিয়ে এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয় বলে মনে করি।
নির্বাচনের আগ মুহূর্তেও পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত রাজনীতি আশাব্যঞ্জক বলে বিশ্বাস করি।
Advertisement
জাগো নিউজ : নির্বাচন কমিশন দৃশ্যমান উদ্যোগ নিচ্ছে। সংলাপের আয়োজনও করল। এ উদ্যোগও আশাবাদীর কারণ হতে পারে কি না?
আকবর আলি খান : সরকার না চাইলে নির্বাচন কমিশন কিছুই করতে পারবে না। বাংলাদেশে সে ধরনের নির্বাচন কমিশন গঠন হয়নি। যেভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন হয় এবং কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া হয়, তাতে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই।
জাগো নিউজ : পাশের দেশ ভারতে তো নির্বাচন কমিশনেই মানুষের অধিক আস্থা...
আকবর আলি খান : সে দেশের নির্বাচন কমিশন অনেক শক্তিশালী। ভারতের নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্যরা। তারা অত্যন্ত মেধাবী এবং জাতির প্রতি দায়বদ্ধ বলে প্রমাণিত।
ভারতের ফেডারেল সরকার নির্বাচনের জন্য বিশেষ সহায়ক। এরপর ভারতের বিচার বিভাগ কার্যকর রয়েছে। এ কারণে ভারতে নির্বাচন নিয়ে বিশেষ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, যা বাংলাদেশে হয়নি। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন চাইলে সব ঠিক হবে, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। যদি অন্য উপাদান সহায়ক হিসেবে না থাকে।
জাগো নিউজ : নির্বাচন কমিশন নিয়ে আশার কথাও তো আছে। আপনারা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ছিলেন তখন তো গতি এসেছিল কমিশনে। মানুষ আস্থাও পেয়েছিল।
আকবর আলি খান : দলীয় সরকার আর তত্ত্বাবধায়করের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন যে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পেরেছে, দলীয় সরকারের অধীনে তা পারেনি কোনো নির্বাচনে।
জাগো নিউজ : তাহলে আগামী নির্বাচন নিয়ে আশাব্যঞ্জক হওয়ার কি কারণ থাকতে পারে?
আকবর আলি খান : এমন রাজনীতি থেকে মানুষ মুক্তি চায়, এটিই আশার কথা। শেষ পর্যন্ত কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা বলা যাবে না। রাজনীতি নির্বাচনমুখী হচ্ছে তা বলা যেতেই পারে। জাগো নিউজ : সাধারণ মানুষ রাজনীতির এমন পরিস্থিতি কীভাবে দেখছেন বলে মনে করেন?
আকবর আলি খান : সাধারণ মানুষ রাজনীতি নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে শুধু নির্বাচন ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশে যে ধরনের শাসন ব্যবস্থা বিরাজমান তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার ব্যাপার রয়েছে।
জাগো নিউজ : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই তো রয়েছে বাংলাদেশে এবং সেটাই উত্তম শাসন ব্যবস্থা বলে মনে করা হয়।
আকবর আলি খান : বাংলাদেশে বর্তমানে পরোক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরাজমান। পরোক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জালিয়াতি বেশি হয়। নির্বাচনে কোনোভাবে একটি ভোটের ব্যবধানে একজনকে পাস করিয়ে এনে সংসদে বসাতে পারলে সেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। এ কারণে নির্বাচনে জেতার জন্য যে কোনো পন্থাই অবলম্বন করতে চান রাজনীতিকরা।
জাগো নিউজ : আপনি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?
আকবর আলি খান : শাসন ব্যবস্থায় সব মানুষের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। তবে সেটা গ্রিসের এথেন্স নগরেই সম্ভব ছিল। এথেন্সে অধিকাংশ মানুষই দাস ছিলেন এবং তাদের ভোটাধিকার ছিল না। যারা ভোটে অংশ নিতেন তারাই রাজ্য শাসন করতেন।
এটি তো এখন সম্ভব না। তবে কয়েকটি উপাদান যদি আমরা যুক্ত করি তাহলে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চালু করা সম্ভব বলে মনে করি। এর মধ্যে গণভোট ব্যবস্থা চালু জরুরি। গণভোট ব্যবস্থা থাকলে জনগণ যেকোনো সময় সরকারের প্রতি আস্থা-অনাস্থা প্রকাশের সুযোগ পেতে পারেন। এখনও ষাটেরও অধিক দেশে গণভোট প্রচলিত আছে। ব্রেক্সিট হলো গণভোটের মাধ্যমেই।
এরপর আমি মনে করি, নির্বাচন আনুপাতিক হারে হওয়া উচিত। এতে হয়তো কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। বাধ্য হয়ে হয়তো আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতো। এ ধরনের সরকার একবার গঠন হলে রাজনৈতিক বিদ্বেষ অনেক কমে যাবে। ইউরোপের অনেক দেশেই কোয়ালিশন সরকার আছে। জাগো নিউজ : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন সরকার কি প্রত্যাশা করা যায়?
আকবর আলি খান : না। আপাতত এমন সরকার কোনোভাবেই প্রত্যাশা করা যায় না। কারণ বাংলাদেশের মানুষরাই তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার না। তবে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক হওয়া উচিত। সম্প্রতি একটি বইয়ে এমন বিতর্ক নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি। আমার যে মত সেখানে প্রকাশ করেছি এবং সেটাই যে প্রতিষ্ঠা পাবে তা নয়। তবে আমি মনে করি এ বিতর্ক নিয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি। আলোচনা হলেই সংস্কারের পথ বের হবে।
সংস্কারের জন্য জনমত তৈরির প্রয়োজন রয়েছে এবং সেটা অল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব বলেও মনে করি না। তবে সময় লাগলেও নিরাশ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি সবসময় বিশ্বাস করি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা টেকসই হবে না। জাগো নিউজ : এ ভরসা পাচ্ছেন কোথা থেকে?
আকবর আলি খান : বাংলাদেশের মানুষ ব্রিটিশ বা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধেই যে আন্দোলন করেছে, তা নয়। তেরোশ বছর আগে এ বাংলায় পাল বংশের প্রথম সম্রাটকে জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ওই সময় রাজাকে বলতে হবে যে, জনগণ তাকে নির্বাচিত করেছে। নির্বাচনের প্রতি ঝোঁক এবং জনগণের সার্বভৌমত্বের এ ইতিহাস হাজার হাজার বছরের।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক দুর্বলতা আছে। এটি কোনো পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা নয়। কিন্তু অন্য শাসন ব্যবস্থা থেকে উত্তম তা প্রমাণিত। এ জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
জাগো নিউজ : আমলারা দলীয় কর্মকাণ্ডের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছেন। সম্প্রতি সরকারদলীয় একটি কর্মসূচিতে আমলারা দলবলে অংশ নেন। এটি কীভাবে দেখছেন?
আকবর আলি খান : অবসরে গিয়ে আমলারা রাজনীতি করবেন, দেশের প্রতি অবদান রাখবেন- এতে আমি দোষের কিছু দেখি না।
দোষের বিষয়টি হচ্ছে, আমলাতন্ত্রে থেকে কেউ যদি সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। এমনকি যারা অবসরের পরপরই রাজনীতি করেন, তাদের জন্যও রাজনীতি দূষিত হয়। এ সুযোগ থাকার কারণে অনেক আমলা রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হতে চান এবং হচ্ছেন। আর তখন আমলাতন্ত্র পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে।
জাগো নিউজ : এক্ষেত্রে আপনার পরমার্শ কী?
আকবর আলি খান : আমি মনে করি অবসরে যাওয়ার তিন বছর পর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার বিধান থাকতে হবে। কমপক্ষে তিন বছরের আগে আমলাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিলে আমলাতন্ত্রে দলবাজি হবে। একটু ছেদের প্রয়োজন পড়ে।
জাগো নিউজ : এ ছেদ আসলে কতটুকু বাস্তবসম্মত?
আকবর আলি খান : রাজনীতি দূষণমুক্ত করতে হলে এ ছেদ বাস্তবসম্মত করতেই হবে। অবসরে যাওয়ার পরমুহূর্তেই যদি রাজনীতি করার সুযোগ থাকে তাহলে শেষের দিকে সরকারি কাজের চেয়ে আমলারা রাজনীতিই বেশি করেন। তখন প্রশাসনযন্ত্রকে রাজনীতির জন্য ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়। অনেক দেশে সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রেও এমন নিষেধাজ্ঞা থাকে। গত নির্বাচনী আইনেও এ ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছিল। জাগো নিউজ : এখন যে পরিস্থিতি দৃশ্যমান, তা নিয়ে কী বলবেন?
আকবর আলি খান : আমলাদের রাজনীতির প্রতি যে আনুগত্য, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বাধানিষেধ নেই বলে প্রশাসনযন্ত্র রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দুষ্ট হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করি। চাকরি ও রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে বিশেষ ছেদ না থাকলে আমলারা সরকারের আনুগত্য পেতে যা করবার তা-ই করবে।
জাগো নিউজ : তাহলে কি এসব প্রক্রিয়ায় সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার কাজ করে?
আকবর আলি খান : সরকারের মধ্যে এমন সরকার পৃথিবীর সব দেশেই থাকে। সরকারের মধ্যকার সরকারের সঙ্গে রেষারেষিও থাকে। এসবে অতিউদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। অন্য দেশের ভালো রীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে এসব বিষয় আমাদের কাছে বড় হবে না।
এএসএস/এমএআর/পিআর