‘হালদা’ দেখলাম। লেখাটা মুভি রিভিউ অর্থে লিখছি না। হলে মুভি দেখতে গিয়ে একটা বিশেষ উপলব্ধি শেয়ার করার জন্য লিখছি। আজাদ বুলবুলের কাহিনীতে ‘হালদা’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন তৌকির আহমেদ। তৌকির আহমেদ ‘অজ্ঞাতনামা’ চলচ্চিত্রের পরিচালক। ‘অজ্ঞাতনামা’ দেখার পর তৌকির আহমেদের এই পরিচয় দিতেই ভালো লাগে আমার। আর এ কারণেই আগ্রহ নিয়ে হালদা দেখতে যাওয়া।
Advertisement
শুধু বাংলাদেশেরই নয় এশিয়ার একমাত্র মৎস প্রজনন কেন্দ্র চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত হালদা নদী ও এর দুই পাড়ের জেলেদের জীবন নিয়ে হালদা চলচ্চিত্রের গল্প আবর্তিত হয়েছে। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন- জাহিদ হাসান, নাদের চৌধুরী নামে, বিদেশ ফেরত পয়সাওয়ালা ও ইটের ভাটার মালিক। নুসরাত ইমরোজ তিশা-হাসু নামে, জেলের কন্যা। মোশাররফ করিম- বদিউজ্জামাল, জেলে। ফজলুর রহমান বাবু- মনু মিয়া, হাসুর বাবা। রুনা খান- জুঁই নামে, নাদেরের প্রথম স্ত্রী। দিলারা জামান- সুরৎ বানু, নাদেরের মা।
লেখার সুবিধার্থে কাহিনীর খণ্ডাংশ উল্লেখ করছি। নাদের চৌধুরী থাকে নিঃসন্তান। প্রথম স্ত্রীর ঘাড়ে অক্ষমতা চাপিয়ে বংশ রক্ষার্থে নাদের চৌধুরী দ্বিতীয় বিয়ে করে। বাবার অভাবের তাড়নায় হাসু ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে নাদের চৌধুরীকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। গল্পের টানাপোড়েনে একটা সময় হাসু সন্তানসম্ভবা হয়।
সিনেমার মূল বক্তব্য হচ্ছে হালদা নদীর পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমে মাছের স্বাভাবিক প্রজননধারা অব্যাহত রেখে জেলেদের জীবনযাত্রা টিকিয়ে রাখা। পরিচালক বক্তব্যের সাদৃশ্য বজায় রেখে শেষ পর্যন্ত সরকারি নোটিশে ইটের ভাটা বন্ধ করিয়েছেন এবং নির্মম বাস্তবতার নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সংগ্রাম করে সন্তানসম্ভবা মা হাসুকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অর্থাৎ মানুষের বাসযোগ্য পরিবেশ ও পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে মা মাছ ও মা হাসু দুজনেরই বেঁচে থাকা জরুরি সেটাই পরিচালক বুঝিয়েছেন এবং কাহিনীর আবর্তনের মাধ্যমে দুজনকেই বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।
Advertisement
নিঃসন্দেহে সিনেমার উদ্দেশ্য মহান। জানিনা এ চলচ্চিত্র সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের হালদা তথা সকল নদী, মাছ ও জেলেদের বাঁচাতে কতটুকু প্রভাব ফেলবে! যা হোক যে বিশেষ বিষয়টা বলতে চাচ্ছি সেটা হলো, এ সিনেমা নাদের চৌধুরীর মা সুরৎ বানুর মাধ্যমে এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা বিষয় তুলে ধরেছে। ছোট্ট একটা দৃশ্যের মাধ্যমে সে বার্তা তুলে ধরা হলেও এর তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শাশুড়ি সুরৎ বানুর সাথে হাসুর একটা মমতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুরৎ বানু পা পিছলে পড়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। শয্যাশায়ী সুরৎ বানু হাসুর সাথে তার কষ্টের কথা শেয়ার করে। সুরৎ বানু হাসুকে বলে- এ সংসারে আসার পর তার নামটা হারিয়ে গেছে। কেউ তাকে বউমা বলে ডাকে, কেউ মা, কেউ আম্মা। পরিবারের অনেকে তার নামটাই জানেনা। তাই সে নিজের কষ্টের উপলব্ধি থেকে একজন নারীর নামটা বাঁচিয়ে রাখতে বউমা না ডেকে হাসুর নাম ধরে ডাকে। সে হাসুকেও অনুরোধ করে যেন হাসু তার নাম ধরে একবার ডাক দেয়।
হাসুর চোখে জল আসে। হাসু শাশুড়িকে কয়েকবার সুরৎ বানু বলে ডাক দেয়। দুজনের চোখেই জল। নিঃসন্দেহে এটি কান্না পাওয়ার মত একটি দৃশ্য। হ্যাঁ কান্না পেয়েছে আমাদের মত নিজের অস্তিত্বসচেতন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন কিছু দর্শকের। কারণ এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ঘর-সংসার করা প্রতিটি নারীরই নামটা হারিয়ে যায়। থাকে শুধু অন্যের অস্তিত্বের সম্বোধন হয়ে। অথচ প্রতিটি মানুষ পৃথিবীর বুকে কর্মের মাধ্যমে নিজের নামটাই কেবল বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু হলের অধিকাংশ দর্শক হাসু সুরৎ বানু বলে ডাকার সাথে সাথে হো হো করে হেসে উঠল! তারা নারীর এ ব্যথা উপলব্ধি করতে পারেনি। তারা নিষ্ঠুরভাবে শুধু বিনোদিত হয়েছে।
এরা আসলে কারা? এরা এ সমাজের সেই দূষিত অসার মস্তিষ্ক বহনকারী মানুষ যাদের আপনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বা যেকোন মাধ্যমে যত নৈতিক শিক্ষাই দিতে চান না কেন তারা তা বুঝতে অক্ষম। এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততায় গড়ে উঠেছে। এদের সংখ্যালঘিষ্ঠে নামিয়ে আনা এত সহজ না। তাই প্রয়োজন ইতিবাচক পরিবর্তন। একটু একটু করে পরিবর্তন ঘটাতে হবে যেকোন মাধ্যম ব্যবহার করে। চলচ্চিত্র নিঃসন্দেহে বড় একটি মাধ্যম। সেই সাথে নারীদেরও নিজের অস্তিত্বের পরিচালক হয়ে সংগ্রাম করে নিজের নামটা বাঁচিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। ভালো লেগেছে হালদা। ধন্যবাদ হালদা চলচ্চিত্রের পুরো টিমকে।
লেখক : শিক্ষার্থী।
Advertisement
এইচআর/জেআইএম