এমপির চোখের দেখায় যে গম নিম্নমানের মন্ত্রীর চোখের দেখায় সেই গমই পুষ্টিমানের। কুষ্টিয়ার সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রউফ ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গমের ৫০০ মেট্রিক টন কুমারখালী খাদ্য গুদামে রাখতে দেননি। এমপির নেতৃত্বে জনতার প্রতিরোধে গম গুদামজাত করা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমপির বক্তব্য হলো ‘আমার চোখের দেখায় এই গম অতি নিম্নমানের হওয়ায় তা খাদ্য গুদামে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া আর যাই হোক, অন্তত কুমারখালী খাদ্য গুদামে এই গম ঢুকতে দেওয়া হবে না।’ সংসদ সদস্য তার এলাকায় ওই পচা গম কাউকে খেতে দিবেন না। এটাই হওয়া উচিত। একজন জনপ্রতিনিধি হিসাবে তিনি জনগণের কথাই বিবেচনা করেছেন। এই বিবেচনাবোধটা সরকারের থাকা উচিত ছিল। অথচ খাদ্য মন্ত্রণালয় বারবার বলছে, এই গম অখাদ্য নয়। খাদ্যমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তব্যেও তা-ই বলেছেন। খাদ্য মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও একই কথা বলেছে।পচা বা নিম্নমানের গম আমদানি নিয়ে সরকারের একটি প্রেসনোট আশা করেছিলাম। কারণ বিষয়টি জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত। বিভিন্ন সরকারি বাহিনী এবং সরকারি কর্মচারিদের জন্য এই গম আমদানি করা হলেও পুলিশের সদস্যরা এই গমের আটা খেতে রাজি নয় বলে তাদেরকে আর পচা গম দেওয়া হচ্ছে না। ব্রাজিল থেকে আনা নিম্নমানের গমগুলো এখন দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে খেতে দেওয়া হচ্ছে। খবর আসছে বিভিন্ন জেলায় মিল মালিকরাও এই গম নিচ্ছেন না, পোকাধরা গম থেকে আটা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করলে শুধু লোকসানই হবে না তাদের ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মধ্যে পড়বে। অর্থাৎ কেউই এই গম নিতে চাইছে না।সরকার কোন আক্কেলে এই গম গরীব মানুষকে খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে? গরীব বলেই সরকার তাদেরকে পচা বাশি খাবার দিবে? এতো অমানবিক সিদ্ধান্ত সরকারের কোন পর্যায় থেকে এসছে সেটা জানা দরকার। যে কোনো উপায়েই হোক কম দামে গরীব মানুষকে পচা গম দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে আসতেই হবে। তারা গরীব বলেই পচা গম খাওয়াবেন তা মেনে যায় না। সরকারের এই চিন্তা তাদের অমানবিকতাই ফুটে ওঠে। পুলিশসহ সরকারি বাহিনীর সদস্যরা যখন এই গম নিচ্ছেন না এবং তাদের আপত্তির কারণেই যখন তাদেরকে সেই গম দেওয়া হচ্ছে না এটা সরকারই স্বীকার করে নিয়ে প্রমাণ করেছে যে গমের মান খারাপ। তাহলে এগুলো অন্যদেরকে কেন খাওয়ানো হবে? একজন সংসদ সদস্য যেভাবে তার এলাকার গরীব মানুষের কথা চিন্তা করে নিম্নমানের গম তার এলাকায়ই ঢুকতে দেননি তেমনি জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই এই গম মানুষের খাওয়ার উপযোগী কি না সরকারের উচিত ছিল শুরুতেই তা পরীক্ষা করা। সরকার সেপথে হাঁটেইনি। শুধু তাই নয় গম আমদানি নিয়ে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদেরও আইনের আওতায় আনতে সরকারের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রাজিল থেকে গম নিয়ে একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এলে বন্দর কর্তৃপক্ষ চুক্তি অনুযায়ী অনুমতিপত্র ও নথি দেখতে চায়। তৎকালীন মহাপরিচালক ওই গম খালাসের জন্য অনুমতি দিতে বললে খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক লিখিতভাবে জানান ব্রাজিলের কৃষি মন্ত্রণালয় ও বণিক সমিতি রপ্তানিকৃত গমের নিশ্চয়তাপত্র দেয় না। তাই এই গম খালাস করার সুযোগ নেই। এরপরও অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক গম আমদানির নির্দেশ দিয়ে লিখেন, আমদানির আদেশ দেওয়া চুক্তির অংশ। মহাপরিচালক জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব খাদ্য আমদানির বিষয়ে নিয়মিত তদারকি করে থাকেন। তাঁর কাজ হচ্ছে নিয়মিতভাবে মন্ত্রী ও সচিবকে বিষয়গুলো অবহিত করা। ফলে তার ঘাড়ে সব দায়দায়িত্ব চাপানো ঠিক হচ্ছে না। তিনি বলতে চাচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়েই ওই গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি ওই মহাপরিচালককে পরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার কথা অনুযায়ী শুধু তিনি একাই দায়ী নন, মন্ত্রী-সচিব সবাই এরজন্য দায়ী। কে কতোটুকু দায়ী সেটা নিরুপণ করবে তদন্দকারিরা। খাদ্যমন্ত্রী হন আর খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হন অথবা আরো প্রভাবশালী যে-ই পচা গম আনার সাথে যুক্ত থাকেন না কেন তাদেরকে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আজ না হোক, কাল তাদের নামে মামলা হবে এটা নিশ্চিত। এখন হয়তো সরকার তাদের নামে দুর্নীতির কোনো মামলা দায়ের করবে না বা তদন্তই করবে না। কিন্তু এদেশের ইতিহাস বলে সরকার পরিবর্তন হলেই এই ইস্যুতে মামলা হবে। তারও আগে সরকারি দলের বিরুদ্ধে নির্বাচেন এটা একটা বড় প্রচারণা পাবে। সবচে’ ভালো হয় সরকার যদি সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিষ্চিত করতে পারে। এতে সরকারের দুর্বলতার প্রকাশ নয়, স্বচ্ছ ভাবমূর্তিই বৃদ্ধি পাবে।আরো ভালো হতো খাদ্যমন্ত্রী যদি এর দায় নিয়ে সরে যেতেন। কারণ প্রাথমিকভাবে এর দায়দেনা মন্ত্রীকেই নিতে হবে। যদিও এখন পর্যন্ত গম কেলেঙ্কারির এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এতো বড়ো কেলেঙ্কারির ঘটনায় যদি দোষীরা পার পেয়ে যায় তাহলে ভবিষ্যতে পচা গমই নয় আমাদের যে আরো পচা কী খেতে হবে তা ওই পচা মানুষগুলোই বলতে পারবেন। সরকার চাইলে এই গম বঙ্গপোসাগরে ফেলে দিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এই গম যারা নিয়ে এসেছেন সেই পচা মানুষগুলোকে কী সরকার ফেলে দিতে পারবে। এই কাজটা যতদিন এদেশের সরকারগুলো করতে না পারবে ততদিন পচা চাল, পচা গম বা পচা চিনি আমাদের খেয়ে যেতেই হবে। স্বৈরাচার এরশাদ আমলে চিনি কেলেংকারির ঘটনায় যদি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ‘চিনি জাফর’ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান তাহলে গম কেলেংকারির দায়ে নিশ্চয়ই ‘গম কামরুল’ নামে পরিচিতি পাবেন এ কালের খাদ্যমন্ত্রী। সরকার এখন কী করে সেটাই দেখার বিষয়। এইচআর/এমএস
Advertisement