বিশেষ প্রতিবেদন

'আমরা এখনও ছেলে সন্তানকে বেশি প্রাধান্য দেই'

 

নারীদের কাজের ক্ষেত্রে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রসারিত। দিন দিন তা আরও বেশি প্রসারিত হচ্ছে। তবে তারপরও অদৃশ্য একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে গেছে; খানিকটা সামাজিক-খানিকটা পারিবারিক। সার্বিকভাবে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিও যেভাবে বদলানো প্রয়োজন ছিল সেভাবে বদলায়নি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, চাকরি বা ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজে জড়িত থাকার পরও অনেক নারীকে গৃহবধূর মতোই ঘরের সব কাজের দায় রাখতে হচ্ছে নিজের কাঁধে। এসব নানা বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির বিবিএ ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র লেকচারার অ্যান্ড প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর বেনজির রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাঈম ফেরদৌস রিতম।

Advertisement

জাগো নিউজ : শিক্ষাকে তো আসলে বিদ্যা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিজ্ঞান ইত্যাদি অনেক নামেই অভিহিত করা যায়। বর্তমান সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমান তাল মিলিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন। তবে এ ক্ষেত্রটাও অনেকটা করপোরেট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শোবিজ ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ। এ যে দৃশ্যমান বা অদৃশ্য একটা সীমাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে এখানে সমস্যা কী আছে বলে আপনি মনে করেন।

বেনজির রহমান : আমরা শিক্ষাকে জীবনের অন্যতম মৌলিক চাহিদা বলে থাকি। শিক্ষাই আলো এমন বিশ্বাস নিয়ে বাঁচি। কিন্তু এতকিছুর মধ্যে এটাও একটা রুঢ় সত্য যে আমরা এখনও লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টাকে আমাদের সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে পারিনি। আমরা এখনও ছেলে সন্তানকে বেশি প্রাধান্য দেই। এ নির্মম সত্যটাই আমাদের মেয়েদের এখনও বেঁধে রেখেছে।আমাদের সমাজ এখনও ভাবে যে ‘ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স বা পারিবারিক ও কর্মজীবনের যে ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন তার শতভাগই মেয়েদের দায়িত্ব। একটা মেয়েকে পরিবার, সন্তান ও কর্মক্ষেত্র এ তিনদিক সামলে সামনে যেতে হয়। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই মেয়েরা কিছু সীমিত চাকরি যেমন- শিক্ষকতা, ব্যাংকিং ইত্যাদিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে। এ অদৃশ্য সামাজিক সীমাবদ্ধতাটাই মেয়েদের পায়ে এখনও শিকল পড়িযে রেখেছে। আমি এখনও দেখি অনেক মেয়ে বিয়ের পর ক্যারিয়ার বা চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে শুধুমাত্র পারিবারিক স্বার্থ রক্ষার্থে। তবে আমি এটাও বলব যে এ মনোভাবটা এখন ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। আমি নিজেও আমার উভয় পরিবার থেকে অনেক সহযোগিতা পাই। হয়তো আগামী ২-৩ দশকের মধ্যে এ অবস্থার আরও অনেক পরিবর্তন হবে। আমি অত্যন্ত আশাবাদী এ নিয়ে। বর্তমানে মেয়েদের শিক্ষার হার ও তাদের সাফল্য এ কথাই বলছে।

জাগো নিউজ : আপনার পেশা শিক্ষকতা। অনেকের কাছেই নারীদের জন্য আদর্শ পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বেশ গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ অন্য অনেক পেশার চেয়ে আসলে শিক্ষকতাকে নারীদের জন্য সুবিধাজনক বলে মনে করার একটা প্রবণতা আছে অনেকের মধ্যে। আপনি নিজে যখন শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তখন কি এ ধরনের চিন্তার কোনো প্রবণতা আপনার পেশা নির্ধারণে প্রভাব ফেলেছে? বাস্তবতায় অনেকের মধ্যেই আসলে প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নটা হলো- এ প্রভাবের ইতিবাচক দিক যেমন আছে, নেতিবাচক দিকও রয়েছে। ইতিবাচক বিষয়টাকে কীভাবে আরও বিস্তৃত করা যায়?

Advertisement

বেনজির রহমান : শিক্ষকতা আসলেই ‘আদর্শ পেশা।’তবে এটা শুধুই নারীদের জন্য তা কিন্তু নয়। এটা অত্যন্ত সম্মানজনক একটা পেশা। শিক্ষকদের মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়। আমি যখন পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিলাম তখন শুধুমাত্র নিরাপত্তা বা পারিবাকি কারণে নেইনি। আমার মেধা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার একটা প্রবল ইচ্ছা আমার মধ্যে কাজ করত।

বর্তমানে নারীদের শিক্ষকতায় বেশি আসার প্রবণতার ইতিবাচক দিকগুলো আমি মনে করি-• শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের সাফল্য, ফলাফলের ক্ষেত্রে মেয়েদের অগ্রগতি, অনুপাতে মেয়েদের অধিক হারে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। • ধৈর্যশীলতা; যেটা মেয়েদের মধ্যে অনেক বেশি। • সম্মান ও সাফল্য একত্রে পাওয়া্ • ভিন্ন কর্মপদ্ধতি; যেটা অন্যত্র পাওয়া যায় না।

অনেকেই শিক্ষকতাকে শুধুমাত্র অল্প পরিশ্রম ও ঘরোয়া চাকরি মনে করেন। কিন্তু আসলে শিক্ষকতার বিস্তৃতি গভীরতা অনেক বেশি। এটা আমাদের সমাজকে বুঝতে হবে।

জাগো নিউজ : দেশ ও সমাজ উন্নয়নের মূল ভিত্তি অবশ্যই শিক্ষা। এবং কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়ে মজবুত ভিত্তি অর্জন সম্ভব নয়। তার জন্য সংস্কৃতিক অঙ্গন, খেলাধুলাসহ অন্যান্য আরও অনেক দিকে তাকানোর বিকল্প নেই। আপনার কি মনে হয়, পারিবারিক বা ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে সংস্কৃতিক অঙ্গন বা খেলাধুলার মতো ক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি কম? তা যদি হয়েই থাকে তবে উত্তরণের উপায় কী? আমাদের পারিবারিক যে সংস্কৃতি আছে, যে কৃষ্টি-কালচার আছে তার সঙ্গে কোনো বিরোধ তৈরি না করে কি এ গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব?

Advertisement

বেনজির রহমান : শিক্ষা বলতে আমরা অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই বুঝি। কিন্তু পরিপূর্ণ শিক্ষা হলো প্রাতিষ্ঠানিক ও হাতে-কলমে শিক্ষার সংমিশ্রণ। শুধু বই পড়লেই শিক্ষিত ও রুচিসম্মত মানুষ হওয়া যায় না। তার জন্য সংস্কৃতি ও নিয়মিত পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কর্মসূচি যেমন- খেলাধুলা, অভিনয় ইত্যাদিও আবশ্যক। মেয়েদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু আমাদের সমাজ আজও মেয়েদের পর্দা ও নিরাপত্তার নামে তাদের বেড়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছে। যদিও শহরে আধুনিকতা ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু তাও পুরোপুরি এ বেড়াজালকে ভাঙতে পারেনি। আমি অত্যন্ত খুশি এ দেখে যে, আজকাল মেয়েরা ক্রিকেট খেলছে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে।

না, আমাদের পারিবারিক কৃষ্টি কালচারকে এড়িয়ে মেয়েদের সামনে তুলে ধরা, তাদের সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অবশ্যই এ ধ্যান-ধারণা বদলাতে হবে। মেয়েরা শুধু লেখাপড়া আর গৃহস্থালীর কাজ শিখবে- এমন ধারণা তখনই বদলানো সম্ভব যখন আমরা আমাদের পরিবার পরিজন বিশেষ করে মায়েরা শিক্ষা ও সংস্কৃতির গুরত্ব বুঝব। নেপোলিয়ান বলেছিলেন, আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের সভ্য ও শিক্ষিত জাতি দিব।

আমি এ উক্তিটির সঙ্গে একমত। একজন শিক্ষিত মা-ই তার মেয়েকে এ সমাজের মিথ্য ধ্যান ধাণা থেবে টেনে রে করেএকজন সুদক্ষ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত হতে সহযোগিতা করে দেশ ও দশের উন্নতিতে অবদান রাখতে পারে। এখন মেয়েরা বিভিন্ন সামরিক পেশায় যেমন- পুলিশ, সেনাবাহিনী ইত্যাদিতে যোগ দিচ্ছে কিন্তু ছেলেদের তুলনায় অনুপাতে অনেক কম। মেয়েদের পারিবারিকভাব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করা গেলে তারা এসব পেশায় আরও আগ্রহী হয়ে উঠবে। মেয়েদের মায়ের জাতি, কোমলজতি অসহায় এসব কথা না শিখিযে মায়েদের উচিৎ তাদের মানুষ হিসেবে স্বাবলম্বী করে তোলা। এভাবেই মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গনে ও সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণে দেখা যাওয়া সম্ভব তাদের এসব ক্ষেত্রে আনাগোনা বাড়ানো সম্ভব বলে আমি মনে করি।

জাগো নিউজ : সমস্ত ক্ষেত্রে পুরুষদের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হতে সমস্যা হচ্ছে কেন বলে মনে করছেন?

বেনজির রহমান : এ প্রশ্নের উত্তরে আমি আবারও বলতে চাই আমাদের পারিবারিক সভ্যতা আর সন্তান লালন পালন পদ্ধতিই দায়ী, কিছুদিন আগে ভারতের এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা প্রচার করেছে যে ছেলে সন্তানদের শিখতে হবে যে ছেলেরা মেয়েদের কাঁদায় না, অসমাদর ও অসম্মান করে না। অসাধারণ একটা চিন্তাধারা। আমি মনে করি ছেলেদের পরিবার বিশেষ করে বাবা-মায়েরা যদি এ শিক্ষা দেয় তাদের ছেলেদের তবে ভবিষ্যতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবেই। বর্তমানে পুরুষেরা এ সংকীর্ণ চিন্তাধারা নিয়েই আছে যে মেয়েরা একটা পর্যায় পর্যন্ত উন্নতি করবে। তাদের সন্ধ্যার মধ্যে বাসায় ফিরে সংসার দেখাশোনা করতে হবে। এটি তখনই সম্ভব যখন আমরা মেয়েরা নিজেদের সম্মান করতে শিখব। ডায়ান মেরি চাইল্ডের ভাষায়, আ উম্যান ইজ দ্য ফুল সার্কেল উইদিন হার, ইজ দ্য পাওয়ার টু ক্রিয়েট, নার্চার অ্যান্ড ট্রান্সফর্ম। আমি মনে করি এ দৃষ্টিভঙ্গিই পুরুষদের সংকীর্ণ চিন্তাধারাকে বদলাতে সাহায্য করবে।

জাগো নিউজ : সরাসরি কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের কর্মকাণ্ডে কোনো ধরনের অসহযোগিতামূলক মনোভাব থাকছে কি? যদি থেকে থাকে তবে এর সমাধান কী?

বেনজির রহমান : হ্যাঁ থাকে। পুরুষদের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণা সবসময় কাজ করে যে মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে সুযোগসুবিধা বেশি পায়, পদোন্নতির ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এ ধ্যান ধারণাই প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি পুরুষের অসহযোগিতামূলক আচরণের জন্য দায়ী। আপনি প্রায় ৯৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে দেখেত পাবেন যে পরুষ সহকর্মীরা নারী সহকর্মীদের নানাভাবে অসহযোগিতা করছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয়ভাবেই তারা বাধার সৃষ্টি করছে। পদোন্নতির সময় বাধার সৃষ্টি করা আর কর্মক্ষেত্রে হরহামেশাই রাজনীতির শিকার হচ্ছে মেয়েরা। এর একমাত্র সমাধান হলো পুরুষদের তথা সমাজের সংকীণর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

জাগো নিউজ : নারীরা আগের তুলনায় ঘরের বাইরে অর্থনৈতিক কাজে বেশি করে সম্পৃক্ত হচ্ছে। খুবই ইতিবাচক একটা বিষয়। সেই সঙ্গে নিউক্লিয়ার পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ঘরের কাজ নিয়ে একটা সমস্যা থেকে যাচ্ছে। সেখানে ঘরের কাজও ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া উচিৎ, অর্থাৎ পুরুষকেও ঘরের কাজে সমান অংশীদার হতে হবে। সমাজ নিজে এ বিষয়টার সঙ্গে কতটা মানিয়ে উঠতে পারছে? মানিয়ে নেয়ার এ প্রক্রিয়া আরও গতিশীল করার উপায় কী?

বেনজির রহমান : বর্তমানে সবাই নিউক্লিয়ার বা একক পরিবারে দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্র আর স্বনির্ভরতার কারণে এ প্রবণতা দিনদিন বাড়ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দায়ভারটা মেয়েদেরই অনেক বেশিশ সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা বাবার চেয়ে মায়ের কাছেই দাবি অথবা আবদার করে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এখনও আমাদের তথাকথিত সমাজ মেনে নিতে পারেনি যে পুরুষেরা গৃহস্থালি কাজে সহযোগিতা করবে। কিন্তু বর্তমানে স্বামীরা যথেষ্ট চেষ্টা করে অর্ধাঙ্গীর সহযোগিতা করতে। আমি অনেককেই দেখে বাচ্চাদের স্কুলে দেয়া নেয়া টুকাটাকি গৃহস্থালি কাজ আর বাজার সদাই করাই এখন পুরুষেরা সহযোগিতা করে। আমিও আমার পরিবারের কাছে থেকে যথেষনট সহযোগিতা পাই। কিন্তু এখনও সেই তথাকথিত। মিথ্যা পুরুষালি ধারণাটা রয়েই গেছে যে তারা পরিবারপ্রধান। তাই ঘরের কাজ করা তাদের মানায় না। আমার বিশ্বাস আগামী প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে এ ভ্রান্ত ধারণা নির্মূল করা সম্ভব। আমাদের দেশের বাবারা মেয়ে কাজ করলে কষ্ট পাই। কিন্তু স্ত্রীর কষ্টটা অনেক সময় উপলব্ধিই করতে পারে না। যেদিন পারবে সেদিন থেকে মেয়েদের আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

জাগো নিউজ : স্নাতকোত্তর অনেক নারীকেও দেখা যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক কোনো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকছেন না বা থাকতে পারছেন না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমিত আসনগুলোতে ভর্তিতে অনেক লড়াই করেই তাদের নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হয়েছে। এ বিষয়টাকে কিভাবে দেখছেন।

বেনজির রহমান : খুবই দুঃখজনক হলেও কথাটি সত্য। আমাদের দেশের অনেক মেয়েও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তথাকথিত হোমমেকার হয়ে ঘরে বসে থাকছে। গৃহবধূ/হাউস ওয়াইফ থেকে শব্দটাকে সম্মানার্থে আর আধুনিকতার ছোঁয়া দেয়ার জন্য হোমমেকার করা হলেও মেয়েদের প্রতি বিরুপ আচরণ কিন্তু কমেনি এ সমাজে।

যে মেয়েটা হাজার হাজার ছেলেকে পেছনে ফেলে অসাধারণ রেজাল্ট করে, সেই মেয়েটাই একসময় কালের স্রোতে হারিয়ে যায় অতল গহ্বরে। শুধু আামিই না আমার বিশ্বাস যে কোনো শিক্ষিত বিবেকবান মানুষের কাছেই এটি দুঃখজনক ও কষ্টকর। আমি মনে করি একটা শিক্ষিত মেয়ের নিজের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হলেও স্বাবলম্বী হওয়া উচিৎ। একটা স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরি করা জরুরি। আমার এক সহপাঠী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর অর্জন করার পরও স্বামীর হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন যৌতুক ও নিজস্ব ভিত্তির অভাবে; যা এখনও আমাকে কষ্ট দেয়। শিক্ষাকে স্বেচ্ছাচারিতায় ব্যবহার করা যাবে না কিন্তু শিক্ষাকে কাজে না লাগালে সেই শিক্ষার কোনো মূল্য আছে বলে আমি মনে করি না।

জাগো নিউজ : গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের ওপর ভর করে পরিবারের অর্থনৈতিক চাকার গতি বাড়িয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে সচলও রেখেছেন, অনেক অশিক্ষিত নারী। তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন গ্রামাঞ্চলের নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেক কিশোরী, তরুণী। মোটাদাগে বলতে গেলে, তারা একটা মঞ্চ পেয়েছেন নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শনের। মফস্বলের বা নগরগুলোর মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জন্য এমন কোনো উদ্যোগ নেই। ইদানীং অবশ্য অনেকে ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসায় নিজেকে জড়াচ্ছেন। এ ধরনের কনসেপ্টও তাদের জন্য একটা মঞ্চ হতে পারে। তবে এভাবে যারা আসছেন তারা তো মূলত উদ্যোক্তা। এ ধরনের উদ্যোক্তার সংখ্যা খুব বেশি নাও হতে পারে। তাহলে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জন্য কি আলাদাভাবে কিছু করা সম্ভব নয়?

বেনজির রহমান : আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে নারী স্বাধীনতার প্রতি একধরনের বিরুপ প্রতিক্রিয়া কাজ করে, যা নিম্ন ও উচ্চবিত্তের মধ্যে কিছুটা কম। আজকাল ই-কমার্স বা অনলাইন এর সহায়তায় মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা এখন বিভিন্ন ব্যবসায় কার্যকলাপে অংশ নিচ্ছে এবং অর্থ উপার্জন করছে। কিন্তু আমি মনে করি শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আরও নতুন নতুন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। যেমন : আইটি সেক্টর। এদিকে মেয়েদের পদচারণা অনেক কম। এখন আরও অনেক ব্যবসার ক্ষেত্র আছে যেখানে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সরকারি সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন। যেমন : স্বল্প সুদে ঋণ, বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি। ইতোমধ্যে সরকার স্বল্প সুদে মেয়েদের এসএমই ঋণ দিচ্ছে এবং ৪০% ঋণের কোটা মেয়েদের জন্য নির্ধারণ করা আছে। এক্ষেত্রে সরকারের প্রচারণাটাও অত্যন্ত জরুরি।

জাগো নিউজ : প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মপরিবেশ বা তাদের কর্মপদ্ধতি কতটা নারীকর্মীবান্ধব বলে মনে করেন? প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি বা তাদের আভ্যন্তরীণ কাঠামো নারীদের জন্য আসলে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় কি?

বেনজির রহমান : আমি মনে করি অতীতের তুলনায় এখন অকেটা পরিবর্তন হয়েছে এক্ষেত্রে। কিন্তু তারপরও অনেক সমস্যা রয়েই গেছে। এখনও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, পুরুষ সহকর্মীদেন অসহযোগিতামূলক ও অসৌজন্যমূলক আচরণ, পদে পদে বাধার সম্মুখীন হওয়ার ব্যাপারটা রয়েই গেছে। বিশেষ করে ট্যুর কেন্দ্রীক কাজগুলো এখনও মেয়েদে জন্য প্রতিকূলই রয়ে গেছে।

জাগো নিউজ : রাজধানীতে অবিবাহিত নারীদের থাকার ব্যবস্থার একরকম সসম্যা আছে। সে সমস্যা অবশ্য অবিবাহিত পুরুষদের জন্যও কিছুটা প্রযোজ্য। কথা হলো- কর্মক্ষেত্রেও কোথাও কোথাও অবিবাহিত নারীদের এড়িয়ে চলার একটা প্রবণতা আছে। এ সমস্যা বা এ ধরনের সমস্যা থেকে উত্তরণে করণীয় কী হতে পারে।

বেনজির রহমান : অবিবাহিত মেয়েদের বিশেষ করে যারা পরিবার-পরিজনকে দূরে রেখে চাকরিসূত্রে অন্যত্র থাকতে আসে, তাদের জন্য নিরাপদ বাসস্থান পাওয়া আসলেই একটি দুর্লভ ব্যাপার। বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা আর দুর্নীতিতে ভরা যুগে এ সমস্যার সমাধান তখনই সম্ভব যখন সরকার কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হবে। বাড়ি মালিকদের ভাড়াবিষয়ক নীতিমালা ভালোভাবে জানাতে হবে। ছেলে হোক মেয়ে হোক যথাযথ তথ্যাদি সংগ্রহ করে তা নথিভুক্ত করে সহজেই ভাড়া দেয়া যায়- এটা তাদে বোঝাতে হবে। সরকারি পর্যায়ে কিছু হোস্টেল সুবিধার ব্যবস্থা করলে মেয়েরা কম টাকায় অনেক নিরাপদভাবে থাকার সুযোগ পাবে এবং ক্যারিয়ার গড়ে তোলারও সুযোগ পাবে। অনেকে মেয়েকে মাঝপথে ক্যারিয়ার ছাড়তে হয় শুধুমাত্র বাসস্থান সংক্রান্ত অনিশ্চয়তার কারণে। অনেক পরিবারই তাদের মেয়েকে দূরে পাঠাতে চায় না এ সমস্যার কারণে।

জাগো নিউজ : আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। আপনার পেশাটাই এমন যে আপনার চারপাশ ঘেরা তারুণ্যে, তারুণ্যের উচ্ছ্লতায়। প্রতিবছর আপনার ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করছে, আবার নতুন করে যারা ভর্তি হচ্ছে তারাও বয়সে তরুণ। বর্তমান অর্থনীতি, রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এ যে প্রজন্ম আপনার সামনে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে ঢুকে পড়ছে একদম প্র্যাকটিক্যাল একটা জীবনে। এ প্রজন্মের কর্মকাণ্ড বা চিন্তাভাবনায় আপনি কি এমন কিছু পেয়েছেন যা আসলে আপনাকে ভাবিয়ে তোলে বা যার পরিবর্তন জরুরি বলে মনে করেন?

বেনজির রহমান : আমার শিক্ষকতা জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো তারুণ্যকে অনেক কাছ থেকে দেখতে পাওয়া। তাদের গতিবিধি নির্ধারণে সহায়তা করতে পারা। বর্তমানে তরুণরা অনেক বেশি বুদ্ধিসম্পন্ন, অনেক বেশি সচেতন। কিন্তু একটা বিষয় আমাকে বড়ই ভাবিয়ে তোলে সেটা হচ্ছে তারুণ্যের ইন্টারনেট তথা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক প্রীতি আর বিষণ্ণতা। আমি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রায়ই হতাশা দেখতে পাই। তারা অনেক বেশি উচ্ছল কিন্তু ওদের মধ্যে নেতৃত্বের বড়ই বেশি অভাব। এর অন্যতম বড় একটা কারণ আমি মনে করি বর্তমান যুগের বাচ্চারা বাবা-মায়ের সান্নিধ্য কম পায়। অধিকাংশ সময় তারা কাটায় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং তথা ফেসবুক। অতিরিক্ত যন্ত্রপ্রীতি ওদের করে তুলছে বিষণ্ন। আজকাল তরুণরা ঈদ আনন্দ বলতে বোঝে দামি রেস্টুরেন্ট খাওয়া, সেলফি তোলা আর ফেবুকে পোস্ট করা। তারা সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু ও হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের থে ট্যাবে সময় কাটাতে আর ইউটিউবে ভিডিও দেখতে বেশি পছন্দ করে। এসবের দ্বারা তাদের রুচিবোধ ও মানসিকতা প্রভাবিত হচ্ছে। আমার ভয় হয় যে, এ বিজ্ঞানের যুগে ভেসে যাওয়া তারুণ্য একসময় বিপথে চলে যাবে। শিশুরা খেলনা আর কমিক্সের চেয়ে ইউটিউব দেখতে বেশি পছন্দ করে। এ ব্যাপারে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আরও অনেক সচেতন হতে হবে। আমরা আমার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের বিভিন্ন ক্লাব পরিচালনা করছি যেগুলোর মাধ্যমে ওরা ইন্টারনেট ও মোবাইরে ছোট গণ্ডি থেকে বের হতে সহায়তা করে। বাবা-মা আর শিক্ষক এ দুই সম্পর্কই পারে তরুণদের সঠিক পথ দেখাতে।

এনএফ /এমএস