দেশজুড়ে

আরেক মাইলফলক, উদ্বোধনের অপেক্ষায় রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র

দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের সব থেকে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। ১ হাজার ৬২ একর জায়গার ওপর রাশান ফেডারেশনের সহযোগিতায় এ কাজ এগিয়ে চলছে। নানা জল্পনা-কল্পনা থাকলেও সফলভাবে শেষ হয়েছে প্রথম ধাপের কাজ।

Advertisement

আগামী ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ উদ্বোধন করবেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। এ প্রকল্পের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নতুন দিগন্তের আরেক মাইলফলক ছুতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সার্বিক কার্যক্রম সরাসরি তদারকি করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনায় রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হয়েছে ৫ হাজার ৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ।

এর আগে শুরু হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় বা শেষ পর্যায়ের কাজও। এরই অংশ হিসেবে ৩০ নভেম্বর উদ্বোধন হবে বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল স্থাপনার ‘রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং (উৎপাদন কেন্দ্র)’ নির্মাণকাজ। এ লক্ষে পুরোদমে চলছে স্থাপনাটির ফাউন্ডেশনের (ফাস্ট কংক্রিট পোরিং ডেট বা এফসিডি) সার্বিক কার্যক্রম।

Advertisement

জানা গেছে, দুই পর্যায় মিলে ১ লাখ ১৮ হাজার ১৮০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির কাজ ২০১৩ সালে শুরু হয়েছে। প্রকল্প সমাপ্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। দুই ইউনিটের এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে পাবনা জেলার রূপপুর পদ্মার পাড়ে রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি কর্পোরেশন (রসাটমের) নেতৃত্বে চলছে মহাকর্মযজ্ঞ।

নির্মাণাধীন দেশের একমাত্র ও অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের দ্বিতীয় ও মূল পর্যায়ের কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০ নভেম্বর সকালে প্রকল্প এলাকায় যাবেন।

প্রধানমন্ত্রীর আগমন সম্পর্কে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজও যথাযথভাবে এগিয়ে চলছে। এ প্রকল্পের সফলতার মধ্য দিয়ে দেশে বিদ্যুৎ চাহিদা অনেকটা পূরণ করা সম্ভব হবে।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে ইতোমধ্যে পাবনা, ঈশ্বরদী, ভেড়ামারাজুড়ে মানুষের মনে আনন্দের জোয়ার দেখা যাচ্ছে। সর্বত্র স্বাগত জানিয়ে রঙবেরঙের ব্যানার-ফেস্টুন টাঙানো হয়েছে। আওয়ামী লীগসহ সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাংগঠনিক তৎপরতা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।

এদিকে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বত্র ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সব সংস্থার পক্ষ থেকে কঠোর দৃষ্টি রাখা হচ্ছে সর্বত্র। বলা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকাজুড়ে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

নির্মাণাধীন রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত প্রকৌশলীদের সঙ্গে সরেজমিনে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে মূল স্থাপনার জন্য সয়েল স্টাবলিস্টমেন্টের কাজ পুরোদমেই চলছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মাটি তুলনামূলক নরম হওয়ায় যন্ত্রের সাহায্যে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত সিমেন্ট মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে ১৭ হাজার ৪৫০ কিউবিক মিটার কংক্রিটিং এর কাজ চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। প্রথম পর্যায়ে ৪ হাজার কিউবিক মিটারের কাজ শেষ হয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারির মধ্যেই পুরোটা শেষ হবে। মূল স্থাপনার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হবে ৭০ মিটার করে, আর ফাউন্ডেশনের থিকনেস হবে ৩ মিটার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ইউরিক মিখাউল খোসলেভ বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এ বছরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে সাব বেইজ তৈরি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তৈরি হয়েছে মূল প্রকল্পের ভিত্তি।

তিনি বলেন, প্রতিদিন রাশিয়ার বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশি কর্মী মিলে প্রায় ১ হাজারের বেশি কর্মী দিন-রাত কাজ করছেন। এ প্রকল্পের জন্য থ্রি প্লাস রিঅ্যাক্টর বসানো হয়েছে। যেটি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও আধুনিক প্রযুক্তি। যা শুধু রাশিয়ার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে রয়েছে। আর বাংলাদেশের রূপপুরেই হবে দ্বিতীয় ব্যবহার। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর মূল স্থাপনার কাজ শুরু হলে তার পরের ৬৮ মাসের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের মাধ্যমেই পাওনিয়ার বেইজ ও ইরেকশন বেইজের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এছাড়া চলছে প্রটেকশন ড্যাম (বাঁধ) তৈরির কাজ। ২ দশমিক ৮ কিলোমিটার লম্বা এবং ১৩ মিটার প্রস্থ এ বাঁধের কাজও এগিয়েছে অনেকদূর। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথম পর্যায়ে ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা ছিল। কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত না হওয়ায় ইতোমধ্যেই ৮০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া আরও ২১৯ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।

এছাড়া নতুনভাবে অধিগ্রহণ করা পদ্মার বিশাল চরে চলছে মাটি ভরাটের কাজ। মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী নির্মাণের কাজ অনেকটাই শেষ পর্যায়ে। পাবনা গণপূর্ত অধিদফতর এগুলো বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যেই তিনটি সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এ এলাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০তলা ১১টি বিল্ডিং এবং ১৬তলা ৮টি বিল্ডিংয়ের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। ২২টি সুউচ্চ বিল্ডিং তৈরি হবে এ চত্বরে। এছাড়া থাকবে মাল্টিপারপাস হল, মসজিদ ও স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা। সবমিলে এ প্রকল্পের কাজ অনেকদূর এগিয়েছে।

চলতি কাজের অগ্রগতির বিষয়ে প্রকল্পের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মিজানুর রহমান বলেন, নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে এ রূপপুরে। এটি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার অক্লান্ত প্রচেষ্টা এবং ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে মাইলফলক হবে।

প্রকল্পের নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে বলে জানালেন, প্রকল্প পরিচালক ড. সৌকত আকবর। তিনি বলেন, প্রস্তুতিমূলক নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। রিঅ্যাক্টর বসানোর অর্থাৎ মূল কেন্দ্রের ভূমি উন্নয়নের কাজও শেষ।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ানদের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ সম্মিলিতভাবে মূল কাজের গুণগতমান পর্যবেক্ষণ করছেন। এ কাজে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি বিশেষজ্ঞ, ভারতীয় বিশেষজ্ঞসহ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও রূপপুর প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ ও একাধিক পরিচালক দিন-রাত রাশিয়ান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।

জার্মান বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ড. শহীদ হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক গুণগত মান বজায় রেখেই রাশিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।

একই অভিমত প্রকাশ করেছেন জার্মান পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ বিশেষজ্ঞ আব্দুল হালিম ভূঁইয়া, ভারতীয় নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস কে শর্মা ও আর আর কামাথ।

জানা গেছে, দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ব্যয়ের প্রকল্প হচ্ছে এ রূপপুর পরমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। মোট ব্যয়ের মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে রাশিয়া দিচ্ছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভিভিইআর-১২০০ (এইএস-২০০৬) রিঅ্যাক্টরের দুটি বিদ্যুৎ ইউনিটের (ইউনিট-১ ও ২) সমন্বয়ে ২ হাজার ৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। সেইসঙ্গে এটি পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভৌত অবকাঠামো তৈরি, বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য পরমাণু প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা এবং কার্বনমুক্ত ও বেইসলোড বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করা সম্ভব হবে।

আলাউদ্দিন আহমেদ/এএম/এমএস