এর আগে কেউ কি কখনো মাশরাফিকে এত ওপরে ব্যাট করতে দেখেছেন? বেশির ভাগই বলবেন, না দেখিনি। কারণ মাশরাফি সাধারণতঃ নিচের দিকেই ব্যাট করে থাকেন। বেশিরভাগ সময়ই সাত নম্বরে। সর্বোচ্চ আগের বিপিএলে ৫ নম্বরে ব্যাট করতে দেখা গিয়েছিল তাকে।
Advertisement
তবে ইতিহাস ও পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, মাশরাফিও তিন নম্বরে ব্যাট করেছিলেন। নাহ, শুধু গতকালের ম্যাচেই রংপুর রাইডার্সের হয়ে চিটাগং ভাইকিংসের বিপক্ষেই ওয়ান ডাউন খেলেননি নড়াইল এক্সপ্রেস।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘ওয়ান্ডার বয়’ মাশরাফি একবার টেস্টেও ওয়ান ডাউনে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। তাও কমজোরি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নয়। পুরো শক্তির ভারতের বিরুদ্ধে। ২০০৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভারতের বিপক্ষে চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে টেস্টে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ১৩ মিনিট ক্রিজে থেকে ১৫ বলে এক বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ৪ রানে আউট হয়েছিলেন তিনি।
যদিও ওই একবারই অত ওপরে ব্যাট করা মাশরাফির। পুরো টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে মাশরাফি কখনই জাতীয় দলের হয়ে আর এত ওপরে ব্যাট করেননি।
Advertisement
এ ছাড়া টেস্টে তার ব্যাটিং পজিশন ছিল আট (৭ ম্যাচে ৯ ইনিংস), নয় নম্বরে (১৭ টেস্টে ২৮ বার), দশ নম্বরে (১২ টেস্টে ১৯ ইনিংস) ও ১১ নম্বরে (৭ টেস্টে ১০ ইনিস)। একইভাবে ওয়ানডেতে মাশরাফির ব্যাটিং পজিশন হলো ছয় থেকে ১১। এরমধ্যে ছয় নম্বরে দুইবার, সাত নম্বরে ৮ বার, আট নম্বরে ৪১ বার, নয় নম্বরে ৬৪ বার। ১০ নম্বরে ১৬ ও ১১ নম্বরে তিনবার।
আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ওপরে বলতে পাঁচ নম্বরে ব্যাট করেছেন মোটে একবার। ছয় নম্বরেও নেমেছেন দুইবার। সাত নম্বরে ব্যাট করতে দেখা গেছে পাঁচবার। সবচেয়ে বেশি ২১বার ব্যাট করেছেন আট নম্বরে নেমে। এ ছাড়া নয়নম্বর পজিশনে আটবার ও ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যাট করেছেন দু’বার মাত্র।
সেই মাশরাফি এবার বিপিএলে হঠাৎ তিন নম্বরে নেমে ম্যাচ উইনিং ব্যাটিং করে দেখালেন। তাও কার পাশে? টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ভয়ঙ্কর ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইলের পাশে। যার ব্যাটের তোড়ে সব লণ্ড-ভণ্ড হয়ে যায়। যার উত্তাল উইলোবাজিতে কত বোলারের লাইন-লেন্থ হারিয়ে যায়, যার দিনে বিশ্বের যে কোন বোলারের অবস্থা হয় ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি।’
সেই গেইলের পাশে মাশরাফি ২৪৭.০৫ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট চালিয়ে দলকে জয়ের পথ দেখালেন। সেটা মাশরাফি বলেই সম্ভব। তিনি নিজেকে কখনো ব্যাটসম্যান ভাবেননি। ভাবেনও না। এমনকি এক মুহূর্তের জন্য পেস বোলিং অলরাউন্ডার দাবিও করেননি নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ের মাশরাফি বিন মর্তুজা।
Advertisement
কিন্তু পরিসংখ্যান সাক্ষী দিচ্ছে, পেস বোলিংয়ের পাশাপাশি তিনি ব্যাটিংটাও পারেন। এক কথায় পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার না হলেও দলের প্রয়োজনে সব ফরম্যাটেই মাশরাফির ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠার রেকর্ড আছে।
সেটা কতটা? তার ফিরিস্তি দিতে হলে একটা বিচ্ছিন্ন প্রতিবেদনে সম্পন্ন হবে না। অনেক তথ্য-উপাত্ত আছে মাশরাফির ব্যাটিংয়ের। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ে বোলার মাশরাফির চেয়েও ব্যাটসম্যান মাশরাফির অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।
সময়টা ২০০৫ সালের জানুয়ারির ৬ থেকে ১০ তারিখ। প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। প্রথম ইনিংসে নয় নম্বরে নেমে ৪৪ বলে ৪৮ রানের ঝড়ো ইনিংস খেললেন মাশরাফি। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে হওয়া ওই ম্যাচের শেষ দিকে মাশরাফি ৪৮, খালেদ মাসুদ পাইলট ৪৯ ও মোহাম্মদ রফিকের ৬৯ রানের ইনিংস তিনটিই বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছিল ৪৮৮ রানে।
দ্বিতীয় ইনিংসে জিম্বাবুইয়ানদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে বাংলাদেশ দ্রুত রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করলো। সেখানেও শেষ দিকে মাশরাফির ব্যাট থেকে আসলো ১৬ বলে ১৯ রান।
শুনলে অবাক হবেন, ওই ম্যাচে বোলার আর ব্যাটসম্যান মাশরাফি ছিলেন সমান উজ্জ্বল। বল হাতে তার অবদান ছিল ৫৯ রানে ৩ উইকেট আর ৪৫ রানে ২ উইকেট।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম দুই জয়ের নায়কও মাশরাফি। সেটাও অলরাউন্ড পারফরমেন্সে। প্রথমে ৯ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে নেমে ৪৪ বলে অপরাজিত ৩১ রানের কার্যকর ইনিংস খেলার পর বল হাতে ৩৬ রানে ২ উইকেট শিকার করেন। ম্যাচে বাংলাদেশ জিতলো ১৫ রানে। অলরাউন্ড পারফরমেন্সে ম্যাচ সেরা মাশরাফি।
তার কারিয়ার প্রোফাইলই বলে দিচ্ছে পুরোদস্তুর ব্যাটিং না পারলেও মাশরাফি বিন মর্তুজা কিন্তু একটু-আধটু ব্যাটিং পারেন। তাই তো ৩৬ টেস্টে ৬৭ ইনিংস ব্যাট করে ক্যারিয়ারে তিনটি হাফ সেঞ্চুরি আর ১৮২ ম্যাচে অংশ নিয়ে ১৩৪ ইনিংসের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে একবার পঞ্চাশের ঘরে পৌঁছে যাবার রেকর্ডও আছে তার।
কিন্তু টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে জাতীয় দলের লাল-সবুজ জার্সি গায়ে কখনোই পঞ্চাশের ঘরে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ৫৪ ম্যাচে ৩৯ বার ব্যাট করে সর্বোচ্চ ৩৬। জাতীয় দলের হয়ে কোন বিদেশি দলের সঙ্গে হাফ সেঞ্চুরি হাঁকাতে না পারলেও মাশরাফি বিপিএলে এর আগে দুবার অর্ধশতকে পা রেখেছেন। সেটা বিপিএলের দ্বিতীয় ও তৃতীয় আসরে একবার করে।
এবারের বিপিএলে বোলার মাশরাফি শুরু থেকেই মাথা খাটিয়ে একটু গতি কমিয়ে ভালো জায়গায় বল ফেলে সমীহ আদায় করে নিচ্ছিলেন। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই রংপুর রাইডার্সের হয়ে সবচেয়ে মিতব্যয়ী বোলিং স্পেলটি মাশরাফিরই। তবে সে তুলনায় ব্যাটসম্যান মাশরাফির বাজার যাচ্ছিলো মন্দা। আগের চার ইনিংসে তার রান ছিল ১৩, ১৭, ৩ ও ১৫ ।
তবে সে ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে কাল ১৭ বলে ৪২ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে শুধু রানেই ফিরেননি মাশরাফি, চিটাগং ভাইকিংসের ১৭৭ রানের বিশাল স্কোর টপকে দল জেতাতে তিন নম্বরে নেমে খেললেন দারুণ আত্মবিশ্বাসী একটি ইনিংস।
মাশরাফি ঝড়ো ইনিংস খেলতে পারেন, সেটা সবারই জানা। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে মোহামেডানের হয়ে এক মৌসুমে তিন-তিনটি ম্যাচ জেতানো ফিফটি আছে এই তো বছর দুয়েক আগে; কিন্তু সেটা ছয় বা সাত নম্বরে নেমে। বিপিএলেও আগে যে দুটি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন সেগুলোও পরে নেমে।
আরও একটা কথা জেনে রাখা প্রয়োজন, যে কোনো ফরম্যাটে কোন দেশি ও বিদেশি ব্যাটসম্যানের মধ্যে শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সবচেয়ে বড় ছক্কার মারটি কিন্তু মাশরাফির। সেটা কয়েক বছর আগে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে মোহামেডানের হয়ে এক ম্যাচে মাশরাফি এক ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন। সে বিশাল ছক্কা সোজা শেরে বাংলার গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের ছাদের কার্নিশে গিয়ে লেগেছিল।
কিন্তু তিন নম্বরে নেমে তার ব্যাট কথা বলবে, ওভার পিছু সাড়ে ৯ রানের কঠিন হিসেব নিকেশ সহজ করে দেবেন- তা জানা ছিল না কারো। সেই মাশরাফি এবার বিপিএলে তিন নম্বরে নেমে ম্যাচ উইনিং ব্যাটিং করে দেখালেন।
এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি