মতামত

‘সুপারবাগে’ খুনের আয়োজন

একজন খুনিকে দেখে আমাদের গা শিউরে ওঠে। আমরা তাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। তার মৃত্যুদণ্ড দাবি করি। অথচ, লাখে লাখে মানুষ মারার যে প্রক্রিয়া নীরবে শুরু হয়েছে এবং সে ধারাবাহিকতায় অনেকের মৃত্যু হচ্ছেও সেটা নিয়ে কিন্তু আমরা লা জবাব। এর কারণ কি? উত্তর হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মানুষ হিসেবে আমরা সবাই কমবেশি এ প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছি বিধায় এটাকে আমরা একদমই অপরাধ হিসেবে মনেই করছি না।

Advertisement

এই যে প্রতিনিয়ত আমরা ভয়াবহ অপরাধ করছি অথচ তাকে অপরাধ হিসেবে মনেই করছি না- এটা তো ভীষণ ভয়াবহ ব্যাপার, তাই না? ঠিক আছে আপনি হয়ত মেনে নিতে চাচ্ছেন না যে কথিত “মানুষ হত্যা”র মতো কোনো কাজে আপনি সম্পৃক্ত হচ্ছেন। এখানে মানুষ হত্যা মানে কুপিয়ে, পিটিয়ে বা অন্যকোনো নৃশংস পন্থায় মেরে ফেলার কথা আমি বলছি না।

শুধু বলব, আসুন সম্মিলিতভাবে আমরা আয়নায় নিজ নিজ মুখখানি দর্শন করি। আর কিভাবে তৃতীয় বিশ্বে আমরা নিজেদেরকে নিজে প্রতিনিয়ত খুন করে চলেছি বা খুন করার আয়োজন আরো শক্তভাবে করে চলেছি নিজেদের অজান্তেই ( হ্যাঁ, নিজেদের অজান্তে বলছি। কারণ, এটা ভেবে হয়ত সান্ত্বনা পাবেন !!) সেটা ঐ আয়নায় অবলোকন করি।

আচ্ছা, বলুন তো আমার, আপনার বা নিকটজনের জ্বর, সর্দি, কাশি বা একটু পেট খারাপ- এমন হলে আপনি কি করেন? হয়ত ভাবছেন এটা কোনো প্রশ্ন হলো! কারণ উত্তর তো সবারই জানা। আর সেটা হচ্ছে, বাসার কাছের বা পাড়া মহল্লার ফার্মেসি নামক দোকানে গিয়ে সমস্যার কথা বললেই তো হলো। তখন কি সুন্দর করে ওরাই তো এন্টিবায়োটিক নামক ওষুধের দু’চার ডোজ হাতে ধরিয়ে দেন। আবার অনেক সময় নিজে নিজেই ফার্মেসি থেকে দু’চার ডোজ এন্টিবায়োটিক কিনে আনি। আর তা খেয়েই তো দিব্যি সুস্থ হয়ে যাই।

Advertisement

আপনি এ ওষুধ খেয়ে হয়ত আপাত ভালো হয়ে গেছেন। এবং হয়ত ভাবছেন, ফার্মেসির ভাইজান, চাচা বা মামা আমার কত কাছের মানুষ। তাই যে কোন সমস্যায় বারবার তার কাছে ছুটে যান। আর ভাবেন শুধু শুধু ডাক্তার দেখিয়ে লাভ কি! তাছাড়া, কত বড় বড় ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনের ভুল ফার্মেসিওয়ালা অবলীলায় ধরে দেন! তাই এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনও গলির বা পাড়ার মোড়ের ফার্মেসিওয়ালা কথিত “ডাক্তার সাহেব” কে না দেখিয়ে একটা ওষুধও হয়ত আপনি খান না।

এই যদি হয় আপনার সচেতনতার নমুনা তাহলে বলার কিছুই নেই। শুধু বলব তাহলে আপনি মানুষ হত্যার অলিখিত যজ্ঞে আপনার অজান্তেই বেশ ভালোভাবে শামিল হলেন। কারণ আপনি কথিত ফার্মেসিওয়ালা ( মূলত ওষুধের দোকানদার) যার পড়াশোনার দৌড় স্কুল না পেরোনো অবধি হয়ত, কিছু কিছু এন্টিবায়োটিক, ব্যথা আর গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের নাম জেনেই যিনি দিগগজ “পণ্ডিত ডাক্তার” আপনার কাছে, যিনি বড় বড় ডাক্তারকে ছাতু বানিয়ে ফেলছেন প্রতিনিয়ত বিপদে তার কাছে ছুটে না গেলে কেন আপনার ভালো লাগবে বলুন? কিন্তু এই কথিত সচেতনার ভেতরেই যে ভয়াবহ অস্বাভাবিকতা লুকিয়ে আছে সেটা কিন্তু আপনি একদম বুঝলেন না। এখন আসুন দেখি অস্বাভাবিকতা কোথায়! কিভাবে তা আমাদেরকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আমাদের আশেপাশে যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো ওষুধের দোকান, ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। সেই সাথে আছে অসংখ্য মানহীন ওষুধের ফার্মাসিউটিক্যালস। কি ওষুধ তৈরি করছে আর কিভাবে তা বিক্রি হচ্ছে সেটা কিন্তু যথাযথভাবে মনিটিরিং হচ্ছে না। ফলে কি হচ্ছে জানেন? এই যে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আপনি অযথা এন্টিবায়োটিক খেলেন এবং তা পুরো মাত্রায় যথাযথ নিয়মে খেলেন না এতে আপাত ভালো হলেও আপনি কিন্তু নিজের জন্যই পরবর্তী সময়ে ভীষণ জটিলতার সৃষ্টি করলেন। সেই সাথে অন্যদের জন্যও।

নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছেন জটিলতাটা কি? উত্তর হচ্ছে, এই যে আপনি অসম্পূর্ণ মাত্রায় এন্টিবায়োটিক খেলেন এতে আপনার শরীরে থাকা সব ব্যাকটেরিয়া কিন্তু মারা গেলো না। কিছু পরিমাণে থেকে গেলো। ওরা তখন কি করবে জানেন? ওরা তখন এ ওষুধের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে ওষুধ প্রতিরোধী করে গড়ে তুলবে। ফলে দেখা যাবে যে পরবর্তীতে আপনি একই ধরনের রোগে ভুগলেও যথাযথ নিয়মে ঐ এন্টিবায়োটিক দিলেও তা ঐ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে আর কাজ করবে না। শুধু তাই নয়, এসব জীবানু আপনার শরীর থেকে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে আপনার কারণে অন্য যারা পরবর্তীতে এ রোগে আক্রান্ত হবে তাদের শরীরেও ঐ এন্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না।

Advertisement

নিশ্চয় খেয়াল করেছেন হয়তো, ইদানীং নানা ধরনের অসুখে আগে যে সকল এন্টিবায়োটিক বেশ ভালো কাজ করতো এখন তারা আর সেভাবে কাজ করছে না। ওষুধের ডোজ বাড়িয়েও কাজ হচ্ছে না। এতে রোগীর ভোগান্তি বাড়ছে। আর্থিক, শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতি হচ্ছে। সেই সাথে চিকিৎসকেরাও অসহায় হয়ে পড়ছেন। কারণ ওষুধ যদি রোগীর শরীরে কাজ না করে তাহেলে তার করারই বা কি আছে?

ওষুধ প্রতিরোধী এসব ব্যাকটেরিয়াকে বলে “এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স” বা “এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী” ব্যাকটেরিয়া। এসব ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয়ে থাকে “সুপার বাগ”। আবার একইসাথে যেসব ব্যাকটেরিয়া একাধিক এন্টিবায়োটিক বিরুদ্ধে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তাদের কে বলে “সুপার সুপারবাগ”।

এখন তাহলে বলুন, এই যে ব্যাকটেরিয়া এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে নিজেকে শক্তিশালী এবং প্রতিরোধী করে নিজেকে গড়ে তুললো এর দায়ভার কি তাহলে ঐ যে ফার্মেসিওয়ালা, আপনি এবং ভেজাল ও মানহীন এন্টিবায়োটিক ওষুধের প্রস্ততুকারক সবার উপরে পড়বে না? চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে জটিলতা তৈরি হবে তার দায় কে নেবে? এখন সেটা কি আপনি নিবেন না?

অথবা এর পরেও কি বলবেন, আপনার আশেপাশের মানুষগুলোর অসুখজনিত যে ভাগান্তি বাড়বে অথবা ওষুধ কাজ না করার ফলে তার মৃত্যু হবে সেজন্য কি আপনার কোনো দায় নেই? আশাকরি এখন আর বলবেন না যে, এ ব্যাপারে আপনার নিজের কোনো দায় নেই এবং নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে, চিকিৎসক না দেখিয়ে ফার্মেসিওয়ালার কথামতো বা নিজে নিজে ওষুধ কিনে খাওয়ার ফলে কিভাবে আমরা নিজেদেরকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি।

তাই, যে কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক খাওয়ার আগে আসুনে সচেতন হই। সেই সাথে প্রতিজ্ঞা করি যে নিদেনপক্ষে রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া জীবনে একবারের জন্যও এন্টিবায়োটিক খাবো না। আর অবশ্যই ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র মোতাবেক নির্দিষ্ট মেয়াদপূর্ণ অবধি এন্টিবায়োটিক খাব। খেতে খেতে মাঝপথে বন্দ করে দিবো না।

একইসাথে বলব, অতি অবশ্যই নিম্নমানের ওষুধপ্রস্তুতকারক, মজুতদার, সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। আর যত্রতত্র গড়ে ওঠা ফার্মেসিওয়ালারা যেন চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এন্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি না করতে সে ব্যাপারে যথাযথভাবে দৃষ্টি দেয়াও ভীষণ জরুরি। না হলে আমাদের সামনে ভয়াবহ বিপদই হয়ত অপেক্ষা করছে!

লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক।

এইচআর/পিআর