উত্তরাঞ্চলের সব জেলায় ঈদকে সামনে রেখে শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজি চলছে। কল্যাণ তহবিলের নামে এ টাকা উঠানো হচ্ছে। যে টাকা আদায় করা হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক কম টাকার রসিদ দেওয়া হচ্ছে চালকদের। ঈদ বাণিজ্যে একইভাবে শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। জানা গেছে, তারাও গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে চালাচ্ছেন চাঁদাবাজি। ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে আসা ট্রাকগুলোর কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি। প্রতিটি জেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সড়কের মোড়ে মোড়ে চাঁদার এই মহোৎসব চললেও পুলিশ বলছে ভিন্ন কথা। চাঁদা আদায়ের কথা অস্বীকার করে তারা জানায়, সড়কের পরিস্থিতি আগের চাইতে অনেক ভালো।গত মঙ্গলবার সকালে ট্রাকচালক সিরাজুল করিম রংপুরের মডার্ন মোড় থেকে মালামাল বোঝাই ট্রাক নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। সেখানে শুরুতেই তাকে ১শ টাকা চাঁদা দিয়ে গাড়ি চালু করতে হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার জুমারঘর, কাটাখালী, বোয়ালিয়া, ফাঁসিতলা, চাপরিগঞ্জ, কালীতলা পয়েন্টে ট্রাক দাঁড় করিয়ে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। এরপর বগুড়া সীমানায় ঢোকার পর ৫ স্পটে পুলিশ আর পরিবহন শ্রমিকদের প্রকাশ্যে চাঁদা আদায়ের কবলে পড়তে হয়। এখানে মহাস্থান, বনানী, তিনমাথা, চারমাথা, মাটিডালি মোড় ও ২য় বাইপাস এলাকায় চাঁদা দিতে হয় ১০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। কোনো কোনো স্থানে শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে রসিদ দিয়ে চাঁদা নেওয়া হলেও পুলিশ চাঁদা নেয় পরিবহনে থাকা পণ্যের ওপর ভিত্তি করে। বগুড়ার শেরপুরে গত বুধবারও প্রকাশ্যে পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় করতে দেখা গেছে শ্রমিকদের। এখানকার চাঁদার পরিমাণও ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত।বগুড়া ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল মান্নান জাগো নিউজকে জানান, যে চাঁদা উঠছে তা মন্ত্রণালয় অনুমোদিত বৈধ চাঁদা। এটির বিষয়ে পুলিশও অবগত রয়েছে।পরিবহন চালকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী নওগাঁ বাসস্ট্যান্ড, চৌমাচিয়া, মান্দা ফেরিঘাট ও সান্তাহার রেলগেট চত্বরে পরিবহন শ্রমিকরা চাঁদা আদায় করে থাকেন। আগে বাসপ্রতি ১০ টাকা ও ট্রাকপ্রতি ৫০ টাকা নেওয়া হলেও এখন সেই হার বেড়েছে। এখন বাসপ্রতি ৫০ ও ট্রাকপ্রতি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। চালকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, যুব উন্নয়ন অফিসের সামনে বাস শ্রমিকরা (রেজি. নম্বর-২৩৮) ২০ টাকার রসিদ দিয়ে ১০০ টাকা আদায় করছেন। নওগাঁ বাইপাস সড়কের ফতেপুর এলাকায় পিকআপভ্যান মালিক সমিতির (রেজি. নম্বর-২৬৫০) নামে ৫০ টাকার রসিদ দিয়ে আদায় করা হচ্ছে ২০০ টাকা। এ ছাড়া তালতলী ও তুলসীগঙ্গা সেতুর কাছে ট্রাক সমিতির নামে ইচ্ছামতো চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।দিনাজপুরের হিলিবন্দর থেকে পণ্য নিয়ে একটি ট্রাককে ঢাকায় যেতে কমপক্ষে ১৩ জায়গায় দুই হাজার টাকার বেশি চাঁদা দিতে হচ্ছে। ট্রাকচালক সামসুল মিয়া জাগো নিউজকে জানান, বন্দর থেকে বের হওয়ার পর থেকে চাঁদা দেওয়া শুরু হয়। ২০ টাকার রসিদ দিয়ে নেওয়া হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এভাবে গাইবান্ধা ও বগুড়া হয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে তাকে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে।সিরাজগঞ্জের কড্ডার মোড়, ভূইয়াগাঁতী, ষোলমাইল, চান্দাইকোনা, সলঙ্গা, মহিষলুটি, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া এলাকায় পরিবহন মালিক-শ্রমিকের নামে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জের কড্ডার মোড়ে মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলগামী বাস ও ট্রাকের চাঁদা আদায়ের দায়িত্বে আছেন রফিকুল ইসলাম। আর উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকার দিকে যাওয়া যানবাহনে চাঁদা তোলার দায়িত্বে আছেন মন্টু শেখ। তারা প্রকাশ্যে পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় করছেন।জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আনসার আলী জাগো নিউজকে জানান, কড্ডার মোড়ে বৈধভাবে যানবাহন প্রতি ৫০ টাকা করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত আছে। উত্তরাঞ্চলের সব জেলায় এভাবে চাঁদা নেওয়া হয়। তবে অধিকাংশ সময় চাঁদার হার মানা হয় না।এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চল মহাসড়কে চলাচলকারী প্রতিটি কোচ ও ট্রাক এ ঘটনার শিকার। পলাশবাড়ী উপজেলা শহরের ট্রাকচালক আবদুস সাত্তার, উত্তম পাল ও যাত্রীবাহী বাসের সুপারভাইজার খয়বর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, চাঁদা না দিলে কাগজপত্র পরীক্ষার নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখে পুলিশ। আর শ্রমিকরাতো লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে মারপিট করার জন্য।তবে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাশিদুল হক জাগো নিউজকে জানান, হাইওয়ে পুলিশের চাঁদা আদায়ের কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয়। কারণ, সীমিত সংখ্যক পুলিশ সদস্য নিয়ে মহাসড়ক টহল দিতেই তাদের সময় যায়।চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা ট্রাক চালক সামসু মিয়া জাগো নিউজকে জানান, মঙ্গলবার রাজশাহীর প্রবেশমুখে কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় তাকে ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। এরপর নাটোরে ১৬০ টাকা। সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়ে ১৮০ টাকা। যানবাহন চালকদের দেয়া তথ্য অনুসারে রাজশাহীর তিন স্পটে চলছে চাঁদাবাজি। নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা, তালাইমারী ও কাটাখালী এলাকায় প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি চলছে পণ্যবাহী ট্রাকে। নগরীর প্রবেশমুখে কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় রাজশাহী জেলা ট্রাক, ট্যাঙ্কলরি ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন ও রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন যৌথভাবে চাঁদার রসিদ দিয়ে যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করছে। যানবাহন প্রতি ৩০ টাকা চাঁদা আদায়ের রসিদ দেওয়া হলেও নেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা। কাশিয়াডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ি থেকে মাত্র ৩০-৪০ গজ দূরে শ্রমিকরা লাঠিসোটা নিয়ে গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায় করেন।রাজশাহী জেলা ট্রাক, ট্যাঙ্কলরি ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাইনুল হক মনা জাগো নিউজকে জানান, ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যানবাহন প্রতি ৩০ টাকা করে চাঁদা আদায় করার নির্দেশ দেওয়া আছে। আদায় করা অর্থ কোনো শ্রমিক মারা গেলে, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা ও শ্রমিকদের মধ্যে যাদের সন্তান লেখাপড়ায় ভালো, তাদের বৃত্তি দেওয়া হয়। ৩০ টাকার বেশি চাঁদা কোথাও ওঠে না।বগুড়া-নাটোর আঞ্চলিক মহাসড়কে গিয়ে দেখা যায় সড়কের ধারে বড় হাটের কাছাকাছি এলাকায় চাঁদা আদায়ে মাঠে নেমেছে একদল তরুণ। মহাসড়কের বিশেষ পয়েন্টগুলোতে হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্ট এবং থানার পুলিশও আছে। তাদের সামনেই নেয়া হয় চাঁদা। নন্দীগ্রাম হাট, ওমরদীঘি হাট, বীরগ্রাাম বাসস্ট্যান্ড, দেছমা চৌমাথা এলাকা পার হয়ে নাটোর সীমানাতেও আছে অনেক পয়েন্ট। এই সড়কে চলাচলরত আব্দুল গফুর, আমিনুল ইসলাম ও আকরাম আলী মোল্লা নামের ৩ জন ট্রাক চালক জানান, ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ তো পুরো বছরই রাস্তায় থেকে `টোকেন` বাণিজ্য করেন। টোকেন বাণিজ্য মানে হলো, নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ নিয়ে সাঙ্কেতিক চিহ্নের এক চিলতে কাগজ পণ্যবাহী যানবাহনের (বিশেষ করে ট্রাক) চালকের কাছে দেয়া। এই কাগজই নির্দিষ্ট সীমানা পার হওয়ার ছাড়পত্র। কত পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার হলো তার হিসেবও থাকে। ঈদের আগে পণ্যের ধরন দেখে ট্রাকের রেট আলাদা হয়। ধানের মৌসুমে ধান বোঝাই ট্রাকের রেট থাকে আলাদা। আবার গরুবাহী ট্রাকের রেট আলাদা। একইভাবে বগুড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যদের কল্যাণের নামে আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার পৌর এলাকায় নওগাঁ-বগুড়া মহাসড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে। মোটরযান চালক সূত্রে জানা গেছে, সান্তাহার শহরের ঢাকা রোড, তিন মাথার মোড়, মালশনের মোড়, পোওতা রেলগেট এলাকাসহ কয়েকটি মোড়ে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। আমান আমিন নামের একজন মাইক্রোবাস চালক জাগো নিউজকে জানান, বগুড়া, সান্তাহার ও নওগাঁর প্রতিটি মোড়ে ৩০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। একাধিক ভটভটিচালক জানান, তাঁদেরও বিভিন্ন চেকপোস্টে সমপরিমাণ চাঁদা দিতে হয়। পিকআপ ভ্যানচালকরা অভিযোগ করেন, লাঠি হাতে তাদের থামিয়ে জোর করে চাঁদার রসিদ ধরিয়ে দেওয়া হয়। চাঁদা না দিতে চাইলে মারধর ও গালাগাল করে। ঢাকা রুটে চলাচলকারী কোচের কয়েকজন চালক জানান, মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যরা নওগাঁ শহরে ঢোকা এবং বের হওয়ার সময় সান্তাহারে ৫০ টাকা করে চাঁদা নেন।ওই এলাকায় চাঁদা আদায়ের সার্বিক দায়িত্বে থাকা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য মামুন জাগো নিউজকে বলেন, স্থানীয় মোটর শ্রমিক নেতা মাসুদ চৌধুরী ও আব্দুল মতিনের নির্দেশে আমরা চাঁদা আদায় করছি। আর মজনু এই রুট ইজারা নিয়েছেন। আমরা পাঁচ-সাতজন বিভিন্ন যানবাহন থেকে টাকা আদায় করে মজনুর কাছে জমা দিই। পরে এসব টাকা অফিসে জমা হয়। এ বিষয়ে চাঁদা আদায়ের দায়িত্বে থাকা ইজারাদার মজনুর ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সান্তাহার মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, চাঁদা আদায়ের জন্য বগুড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের অনুমোদন রয়েছে। আদায় করা টাকা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যদের কল্যাণে খরচ করা হয়। বগুড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন শেখ হেলাল জাগো নিউজকে বলেন, বাস ও সিএনজি (অটোরিকশা) ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন থেকে চাঁদা তোলা হলে তা বেআইনিভাবে তোলা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কারো বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।বগুড়ার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান খান জাগাে নিউজকে জানান, চাঁদা আদায় করার কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। অভিযোগ পেলে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন।এমজেড/এমএস
Advertisement