খেলাধুলা

সেই আরিফুল এখন সত্যিই পাদপ্রদীপের আলোয়!

এখন হয়ত আগের সেই জৌলুস নেই। কিন্তু এক সময় মানে ৭০, ৮০ ও ৯০ দশকে দর্শক ভর্তি স্টেডিয়ামে মোহামেডান-আবাহনী ক্রিকেট ম্যাচে একটি সেঞ্চুরি মানেই ছিল পাদপ্রদিপের আলোয় উঠে আসা।

Advertisement

বাংলাদেশ তখনো আইসিসি ট্রফি খেলতো। ঢাকা, ফতুল্লা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেটে এমন নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আসর বসতো না। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটই ছিল দেশের ক্রিকেটের মূল আসর। সেখানে ভাল খেলা, বিশেষ করে দুই জনপ্রিয় দল ও বৃহৎ ক্রীড়া শক্তি মোহামেডান-আবাহনী দ্বৈরথে শতরান করার অর্থ ছিল সবার চোখে পড়ে যাওয়া। রীতিমত তারকাও বনে যাওয়া।

কিন্তু এখন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সেই আকর্ষণ নেই। এখন মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচের সেই আকর্ষণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর গুরুত্বও নেই। তাই ঐ দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বির লড়াইয়ে সেঞ্চুুরি করলেও তা আর আগের মত বড় করে দেখা হয় না।

মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে সেঞ্চুরি করে আর আগের মত তারকা লেভেল গায়ে আঁটা যায় না। তাই যদি হতো , তাহলে জাতীয় দলের যে ব্যাটসম্যানের মেধা, মনন ও প্রজ্ঞা নিয়ে রীতিমত প্রশ্ন উঠেছে, সেই লিটন দাস এখন অনেক বড় তারকা বলে গণ্য হতেন। কারণ গত দুই লিগে আবাহনীর হয়ে মোহামেডানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছেন এই ব্যাটসম্যান কাম উইকেটকিপার। কিন্তু কঠিন সত্য হলো, ক'জন তা মনে রেখেছে?

Advertisement

এখন সবার দৃষ্টি থাকে জাতীয় দলে। ঢাকা লিগে ভালো খেলে হিরো হবার দিন শেষ। জাতীয় লিগ আর বিসিএলে সেঞ্চুরি করে হয়ত নির্বাচকদের চোখে পড়া যায়, তবে সাধারণ দর্শক ও অনুরাগির মন জয় করা কঠিন।

সবাই এখন শুধু জাতীয় দল, 'এ' দল আর যুব দলের পারফরমেন্সকেই মূল্য দেন। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাল খেলতে না পারলে ঢাকা লিগ খেলে মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে সেঞ্চুরি করে তাই দর্শক প্রিয় হবার দিন শেষ।

আজ শেরে বাংলায় ব্যাট হাতে জ্বলে উঠে রাজশাহী কিংসের বিপক্ষে খুলনা সিক্সার্সকে জেতানো আরিফুলকেও তাই অনেকেই সেভাবে চেনেননা। কেউ কেউ হয়ত তাকে আনকোরাই ভাবছেন। আসলে তা নয় মোটেই। আরিফুল আনকোরা বা অখ্যাত কিংবা অপরিচিত কেউ নন।

ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট এবং জাতীয় লিগের পরিচিত মুখ। খুব বেশী দিন আগের কথা নয়। গতবারের আগের বার মানে ২০১৫ সালে ফতুল্লা স্টেডিয়ামে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে মোহামেডানের হয়ে আবাহনীর বিপক্ষে দারুণ সেঞ্চুরি করেছিলেন আরিফুল। আর এই সেদিন বিপিএল শুরুর ঠিক আগে রংপুরের হয়ে জাতীয় লিগের শেষপর্বেরও সেঞ্চুরিয়ান এই আরিফুল। কিন্তু ক'জন তা মনে রেখেছে? রাখেনি। রাখেনি বলেই আরিফুল এখনো তেমন পরিচিতি পাননি।

Advertisement

তবে এবারের বিপিএল তারকা খ্যাতি এনে না দিলেও তার পরিচিতি যে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে বা দিবে; তাতে সন্দেহ নেই। কারণ খুলনা সিক্সার্সের হয়ে এ যুবা সত্যিই ভালো খেলছেন। আজ নিয়ে তিন ম্যাচে জ্বলে উঠলো তার ব্যাট।

সিলেট পর্ব শেষে বিপিএল ঢাকায় ফেরার দ্বিতীয় দিনই চিটাগাং ভাইকিংসের বিপক্ষে ছয় নম্বরে নেমে দারুণ ব্যাটিং করেছিলেন আরিফুল। ২৫ বলে ৪০ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে খুলনা সিক্সার্সের জয়ে রেখেছিলেন বড় ভূমিকা। একটি মাত্র বাউন্ডারির সাথে চার ছক্কায় সাজানো ঐ ইনিংসই বলে দিচ্ছিলো আরিফুল ‘বিগ হিটার।’ ঐ ম্যাচে তার শেষ দিকের ঝড়ো ইনিংসেই ১৭০ ‘র ঘরে পৌছে শেষ অবধি ১৮ রানের জয় পায় খুলনা।

এরপর ১৭ নভেম্বর শেরে বাংলায় আবার চিটাগাং ভাইকিংসের বিপক্ষে আরও একটি কার্যকর ইনিংস উপহার দেয়া। ১৪১.৬৬ স্ট্রাইকরেটে ২৪ বলে ৩৪ রানের ইনিংস খেলা। যাতে কোন বাউন্ডারি না থাকলেও ছিল তিন তিনটি বিশাল ছক্কা। ঐ আক্রমনাত্মক ইনিংসে খুলনা জেতে ৫ উইকেটে।

আর আজ শেরে বাংলায় আবারো আরিফুলের জ্বলে ওঠা। ১৯ বলে চার বাউন্ডারি ও দুই ছক্কায় ৪৩ রানের হার না মানা ইনিংস খেলে দল জিতিয়ে বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফেরা।

১৬৭ রান করতে গিয়ে ভালো অবস্থা থেকেও এক সময় ধুঁকছিলো মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল। শেষ তিন ওভারে দরকার ছিল ৩৬ রানের। হাতে ছিল মোটে ২ উইকেট। একপ্রান্তে আরিফুল ৭ বলে ৬ নট আউট। অন্যদিকে পেসার মোহাম্মদ সামি (২ বলে ১ রান)।

খুলনা সমর্থকরা জয়ের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। তারা বার বলাবলি করছিলেন, ইস এখন যদি অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ থাকতেন, তাহলে হয়ত জিতেই যেত দল! কিন্তু তিনি তো নেই, ৪৪ বলে ৫৬ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে আউট হয়ে গেছেন। পাকিস্তানী পেসার সামিকে সাথে নিয়ে আরিফুল কি আর ওভার পিছু ১২ রান করে দল জেতাতে পারবেন? এমন গুঞ্জন যখন গ্যালারিতে। ঠিক তখনই জ্বলে উঠলো আরিফুলের ব্যাট।

তাও এমন এক বোলারের বলে, যিনি রাজশাহীর হয়ে এ ম্যাচে সবচেয়ে ভালো বল করেছেন। নরসিংদীর ১৯ বছর বয়সী দ্রুতগতির বোলার হোসেন আলি তার আগে খুলনা অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে বোল্ড করে রাজশাহীকে খেলায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু তার করা ১৮ নম্বর ওভারে প্রবল আক্রমণ আরিফুলের।

প্রথম ও তৃতীয় বলে দুই বাউন্ডারি হাঁকানোর পর এক ছক্কায় তুলে নিলেন ১৮ রান। তাতেই জয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া। এরপর ১৯ নম্বর ওভারে মোহাম্মদ সামিকে আবারো বাউন্ডারি আরিফুলের। ঐ ওভারে উঠলো ৯ রান।

শেষ ওভারে জিততে খুলনার দরকার পড়লো ৯ রানের। বোলার ওয়েস্ট ইন্ডিজ মিডিয়াম পেসার ডোয়েন স্মিথ। তার প্রথম বলটি ছিল লো ফুলটচ। হাটু মুরে ঘুরিয়ে মারলেন আরিফুল। বল সোজা গিয়ে স্কোয়ার লেগের ওপর দিয়ে সীমানার ওপারে আছড়ে পড়লো।

ঠিক পরের ডেলিভারিকে ফুলটচ করে নিয়ে ফাইন লেগে সুইপের মত খেললেন আরিফুল। ফাইন লেগ ফিল্ডার ছিল ৩০ গজের ভিতরে । তাই বল ব্যাটে লাগা মাত্র আরিফুল বুঝে ফেললেন কাজের কাজ হয়ে গেছে। তাই প্রান্ত বদলের চেষ্টা না করে সোজা দৌঁড় দিলেন ড্রেসিং রুমের দিকে। ততক্ষণে খুলনা টাইটান্সের পুরো দল হৈ হৈ করতে করতে মাঠে।

জয়োৎসবটা ড্রেসিং রুমের আগে মাঠের ভিতরই হয়ে গেলো। যার মধ্যমণি আরিফুল। সব নামী-দামি তারকা সাজঘরে ফেরার পর একা লড়ে দল জেতানো আরিফুলকে নিয়ে অমন উৎসব, আনন্দ হতেই পারে। এমন ম্যাচ উইনিং ব্যাটিংয়ের পুরষ্কার হিসেবে ম্যান অফ দা ম্যাচও হয়ে গেলেন রংপুরের এ ২৬ বছরের যুবা।

এআরবি/এমএমআর/জেআইএম