বিশেষ প্রতিবেদন

স্বর্ণ চোরাচালান : মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর-দুবাইয়ের সিন্ডিকেট শনাক্ত

সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে বসে বাংলাদেশে স্বর্ণ চোরাচালান করছে অসংখ্য বাংলাদেশি প্রবাসী। এ ধরনের একটি সিন্ডিকেটকে শনাক্ত করেছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

Advertisement

গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এ তিন দেশ থেকে চোরাচালানের একটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন পাঁচজন। তারা হলেন- মোহাম্মদ আলী, মাসুদ করিম, মিন্টু, হামীম ও দিনাজ। এ চোরাচালানে তারা প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যবহার করছেন। বিনিময়ে শ্রমিকদের দেয়া হচ্ছে বিমানভাড়া অথবা ৩০ থেকে ৪০ হাজার নগদ টাকা।

শুধু তাই নয়, বিমান ও সিভিল  এভিয়েশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের তিন কর্মচারীকে পৃথক দিনে হাতেনাতে গ্রেফতার করে শুল্ক গোয়েন্দা ও পুলিশ। এরপর তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরও বেশ কজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।

গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, স্বর্ণ চোরাচালানের নিয়ন্ত্রক ওই পাঁচজনের আওতায় কর্মরত কিছু প্রবাসী শ্রমিকের নাম পাওয়া গেছে। তারা হচ্ছেন আজমীর, রিয়াজ, মো. শাহিন, মো. রেজা, মানিক, মাসুদ, করিম রানা, রহমত বারী, মুরাদসহ আরও কয়েকজন।

Advertisement

এ বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন বিদেশে বসে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১৪ সালে পল্টনের একটি বাড়ি থেকে আটক ৬১ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার মামলার অন্যতম আসামি মোহাম্মদ আলী এখন দুবাইয়ে বসবাস করছেন। আরও অনেকে বিদেশে বসে স্বর্ণের অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে ২২ ক্যারেটের একভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ৫০ হাজার ১৫৫ টাকা। তবে সিঙ্গাপুরে সমপরিমাণ স্বর্ণের দাম ভরিপ্রতি ৪০ হাজার ১০০ টাকা। বাংলাদেশের একজন ব্যক্তি ব্যবহারের জন্য সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ৮ ভরি (১০০ গ্রাম) পর্যন্ত স্বর্ণালঙ্কার বাংলাদেশে আনতে পারেন। আর সিঙ্গাপুর থেকে ১০০ গ্রাম স্বর্ণ যে কোনোভাবে বাংলাদেশে আনতে পারলেই প্রতি ১০০ গ্রামে কমপক্ষে ৮০ হাজার টাকা লাভ হয়। আর একসঙ্গে পাঁচ থেকে ছয়টি স্বর্ণের বার আনতে পারলে লাভ সাত থেকে আটগুণ বেড়ে যায়। তাই প্রবাসীদের টার্গেট করে তাদের হাতে স্বর্ণের বার ধরিয়ে দেন চোরাচালানের হোতারা। বহনের পারিশ্রমিক হিসেবে কখনো ঢাকার বিমান টিকিট কখনো ৩০ থেকে ৪০ হাজার নগদ টাকা দেয়া হয়।

গোয়েন্দা পুলিশ ও শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে থাকা পাঁচ ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে চলছে নতুন ওই সিন্ডিকেট। শুধু তাই নয় স্বর্ণ চোরাচালানে সহায়তা দিয়ে দেশের বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার অসাধু কর্মকর্তারা পাচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা। স্বর্ণের চালান বিমানবন্দরের বাইরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিতে তারা সহায়তা করেন। যে কারণে কখনো চালান ধরা পড়ে কখনো পড়ে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় চালান ছেড়ে দিয়ে ছোট চালান আটকে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে।

শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ নভেম্বর স্বর্ণ চোরাচালানকালে সিভিল এভিয়েশনের সিকিউরিটি স্টাফ রেজাউল করিম ও কুদ্দুস নামে দুজনকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে শুল্ক গোয়েন্দা।

Advertisement

ওইদিন বিকেলে রিয়াদ থেকে বিজি-০৪০ ফ্লাইটে করে যাত্রী কুদ্দুস (৩০) অবতরণ করেন। কাস্টমস হলের পাঁচ নং বেল্টের কাছে টয়লেটের ভেতর সিভিল এভিয়েশন স্টাফ রেজাউল করিমের কাছে ওই যাত্রী পাঁচটি স্বর্ণের বার হস্তান্তর করেন। ওঁৎপেতে থাকা শুল্ক গোয়েন্দার সদস্যরা দুজনকেই হাতেনাতে আটক করেন। জব্দকৃত পাঁচ স্বর্ণের বারের ওজন ৫৮০ গ্রাম।

অন্যদিকে শুল্ক গোয়েন্দার উপ-পরিচালক মো. সাইফুর রহমান জানান, গত ৭ নভেম্বর শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকতারা শাহজালাল বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের নিরাপত্তারক্ষী জাকারিয়া ও রিয়াদ হতে ঢাকায় আগত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের বিজি-০৪০ ফ্লাইটের যাত্রী মাসুদ রানাকে হাতেনাতে আটক করেন।

ওইদিন বেলা সোয়া ৩টায় বিজি-০৪০ ফ্লাইট শাহজালালে অবতরণ করে। পরে ওই যাত্রীকে ইমিগ্রেশন পয়েন্ট থেকে শুল্ক গোয়েন্দা অফিসে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, বিমানবন্দরে কর্মরত নিরাপত্তাকর্মী জাকারিয়ার কাছে দুটি স্বর্ণের বার দেয়া হয়েছে। এরপর জাকারিয়াকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার শরীর তল্লাশি করে চারটি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। বোর্ডিং ব্রিজে ডিউটি পাস নিয়ে এ স্বর্ণ চোরাচালানে সহায়তা করে আসছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানান নিরাপত্তাকর্মী জাকারিয়া।

এর আগে গত ১৪ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণসহ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গ্রাউন্ড সার্ভিস সুপারভাইজার ওমর ফারুককে আটক করে শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ওইদন ভোর সোয়া ৫টার দিকে মালয়েশিয়া থেকে বিজি-০৮৭ ফ্লাইটে করে ওই স্বর্ণ আসে।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মইনুল খান জাগো নিউজকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানে আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে সিভিল এভিয়েশন ও বাংলাদেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার বিষয়ে আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি। সম্প্রতি কয়েকজনকে আটক করেছি। সুতরাং বিষয়টি স্পষ্ট।

তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। আমরা মনে করি, কান টানলে মাথা আসে। বিমানবন্দর কেন্দ্রিক স্বর্ণ চোরাচালানে বড় ও মাঝারি শক্তি আছে। গড ফাদার আছে। কর্মকর্তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে চক্রের সদস্যরা ভেতরে ঢুকে এসব করছে। এর সঙ্গে বড় কর্তা, ছোট কর্তা অনেকের নাম তদন্তে পেয়েছি। এসব নিয়ে কাজ চলছে।

শুল্ক গোয়েন্দা ডিজি আরও বলেন, ডিউটি নেই তবুও বিমানবন্দরে থাকাটা সন্দেহের। এটা শুধু ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখলে হবে না। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকেও দেখতে হবে। আমরা অভিযুক্তদের ব্যাপারে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সিভিল এভিয়েশন ও বিমান কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দিয়েছি। ভবিষ্যতে এসব ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

তিনি বলেন, যাদেরকে টাকা দিয়ে স্বর্ণ চালান করা যায়, তাদের দিয়ে তো নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার মতো ঘটনাও ঘটানো সম্ভব। এর দায়ে সংশ্লিষ্ট দফতরকেই নিতে হবে।

এরকম একটি সেফ জোনে যারা সন্দেহজনক ঘোরাঘুরি করছেন তাদের ওপর নজরদারি রাখা হচ্ছে। অনেকের ওপর নজরদারি রয়েছে। তদন্তে উঠে আসা ব্যক্তিরা যতো ক্ষমতাবানই হোক না কেন, তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

এআর/জেইউ/জেডএ/জেআইএম