রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আলোচনার জন্য চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই শনিবার বাংলাদেশ সফর করছেন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও রোহিঙ্গা সঙ্কটে চীন আন্তর্জাতিক ফোরামে মিয়ানমারের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।
Advertisement
চীনের এ ভূমিকার পেছনে কী কাজ করছে? ভূ-রাজনৈতিক নাকি কূটনৈতিক হিসেব? চীনের এ অবস্থানকে ব্যাখ্যা করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক হুমায়ুন কবির।
তিনি বলেছেন, চীনের এ অবস্থান কেন তা বুঝতে হলে তাদের নিজস্ব প্রেক্ষাপটকে বুঝতে হবে। চীনের এ ভূমিকার পেছনে রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং ভূ-রাজনৈতিক বা কৌশলগত হিসেব এ দুটিই কাজ করছে।
‘চীনের কাছে যে কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সংহতি একটা প্রধান বিষয়। রোহিঙ্গা প্রশ্নটিকে মিয়ানমার প্রথমেই তাদের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে সংজ্ঞায়িত করেছে, রোহিঙ্গাদেরকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেছে।’
Advertisement
‘এটা চীনের যে নিজস্ব রাষ্ট্রকাঠামোর দর্শন- তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। শুধু তাই নয়, চীনের নিজেরও মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা অঞ্চল আছে পশ্চিমাঞ্চলে। ওখানেও তারা এ ধরনের সমস্যার আশঙ্কা করে।’
সাবেক এ রাষ্ট্রদূত বলেন, মিয়ানমারের কাছ থেকে রোহিঙ্গা সমস্যার কথা যখন চীন শোনে, তখন তারা ভাবে যে এরকম একটা সমস্যা আমাদেরও আছে- তাদেরও হতে পারে।
তাই রাষ্ট্রকে সবার ওপর স্থান দেয়া এবং সেজন্য অন্য কিছু ক্ষতি হলে তা মেনে নেয়া- এ প্রবণতা চীন, রাশিয়া বা ভারত, সবার মধ্যেই আছে। চীনের কৌশলগত হিসেবটা কি? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চীনের আমদানি পণ্যের মধ্যে আছে জ্বালানি বা তেল-গ্যাস। এ পণ্যগুলো যায় মালাক্কা প্রণালী দিয়ে।
চীন এব্যাপারে খুবই সচেতন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যদি তাদের কোন সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এ প্রণালীটি অবরুদ্ধ করে দিতে পারে। এটা তাদের কৌশলগত ভাবনার মধ্যে আছে। এ জন্যই তারা সরাসরি বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার একটা পথ ব্যবহার করতে চায়। ইতোমধ্যে মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর থেকে চীনের ইউনান বা কুনমিং পর্যন্ত পাইপলাইন দিয়ে তেল-গ্যাস সরবরাহ শুরু করেছে। একটা রেললাইনও করার কথা ছিল। তা ছাড়া তারা অর্থনৈতিক জোন করবে।
Advertisement
‘মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করে তাদের সাপ্লাই লাইনকে খোলা রাখা- এজন্য যে সব দেশ তাদের সহযোগিতা করছে তাদের পাশে দাঁড়ানোর একটা বিরাট কৌশলগত চিন্তা চীনের অবস্থান কী হবে তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে।
কিন্তু মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ৬ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের আশ্রয় নেয়াটা ইতোমধ্যে একটা বিরাট মানবিক সঙ্কটে পরিণত হয়েছে। তারপরও চীন কেন মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে চলেছে?
জবাবে হুমায়ুন কবির বলেন, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে চীনের অবস্থান আসলে এক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ নয়। চীন যেমন বন্ধু হিসেবে মিয়ানমারের পাশে থাকছে, তেমনি রোহিঙ্গাদের অত্যাচারের যেসব বিবরণ বেরিয়েছে তা চীনকে খানিকটা হলেও বিব্রত করেছে।
‘এর প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন নিরাপত্তা পরিষদে প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্ট এসেছে- তখন কিন্তু চীন বা রাশিয়া সেটার বিরোধিতা করেনি।’
এ প্রস্তাবে মিয়ানমারের সরকার এবং সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে ঘটনাগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে। চীন সেখানে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। তাই চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফরকে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ এর আগেও যখন মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমস্যা হয়েছিল তখন চীনকে দূতিয়ালির ভূমিকায় আমরা পেয়েছিলাম, সমস্যা সমাধানের জন্য সামনে যেতে পেরেছিলাম।
‘এখন চীন বা রাশিয়া আমাদের পক্ষে না থাকলেও তারা যে অন্য পক্ষে আছে তাও তারা বলেনি। তারা জাতিসংঘে ভোট দেয়নি, বিরত থেকেছে। তাই আমাদের কূটনীতির এখানে একটা এক্সপ্লোরেশনের জায়গা আছে।’
‘চীন যদি বাংলাদেশের পক্ষে নাও থাকে, অন্তত বিপক্ষে যেন না থাকে এবং একটা নিরপেক্ষ অবস্থানে যদি তাকে রাখা যায়- সেটাও বাংলাদেশের কূটনীতির জন্য একটা ইতিবাচক ব্যাপার হবে- বলেন সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির। বিবিসি বাংলা।
এসআইএস/জেআইএম