‘ঢাকাকে বাঁচানোর জন্য ন্যূনতম যে সুযোগটি ছিল, ফ্লাইওভারের কারণে তাও শেষ হয়ে গেছে। ঢাকার মৃত্যু ঘটিয়েছে ফ্লাইওভারগুলো’- মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগে অধ্যাপক ড. সামছুল হক। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা এ বিশেষজ্ঞ রাজধানী ঢাকার পরিবহন, যানজট, উন্নয়ন, পরিকল্পনা নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। তিনি এ সময় ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তর সময়ের দাবি বলে মন্তব্য করেন। সাক্ষাৎকারের শেষ পর্বটি আজ প্রকাশিত হলো।
Advertisement
জাগো নিউজ : উন্নয়নে চাইলেও সরকার অনেক সময় নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রশ্নে সরকারের মধ্যে অন্য কোনো সরকার কাজ করে কি না?
সামছুল হক : উন্নয়ন প্রশ্নে স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ দাতানির্ভর। অর্থ সাহায্য করে দাতাদেরও কিছু না কিছু গোপন শর্ত থাকে। দাতারা দেখেছে, সড়ক বানালে তাদের গাড়ি বিক্রি হবে। তাদের লাভের উদ্দেশ্য তো থাকবেই। কারণ তাদের টাকাও জনগণের। অন্যদিকে আমাদের সরকারগুলোও জনগণের পালস বুঝেই সিদ্ধান্ত নেয়।
মানুষ চায় চলার স্বাধীনতা, যা সড়ক দেয়। সরকার তা-ই দিতে গিয়ে জনগণের বাহবা পেতে চায়। কোথায় উন্নয়ন করলে ভোট বেশি পাওয়া যাবে সেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সড়কে বিনিয়োগ করে। কৌশল এক বিষয় আর জনপ্রিয়তা আরেক বিষয়। সরকারগুলো জনপ্রিয়তার দিকে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
Advertisement
জনগণ চায় ঘরে ঘরে সুবিধা, সরকার চায় ভোট এবং দাতারা চায় গাড়ি বিক্রি। মূলত এ তিনটিই সড়কে মেলে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী চিন্তা নিয়ে সরকার কৌশলী হলে জনপ্রিয়তাকে এভাবে গুরুত্ব দেয়ার দরকার পড়ে না। সস্তা জনপ্রিয়তা, বিনিয়োগের গোপন এজেন্ডার কারণে মানুষ ভুলে গেল যে রেলের একটি অমিত সম্ভবনা ছিল।
মানুষ এক টাকায় লিজ নিয়ে রেলের জমি দিয়ে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। রেলের হাজার হাজার একর জমি অন্যেরা ব্যবহার করছে। আপনি রেলকে তার জমি ব্যবহার করার সুযোগ দিলেন না। অথচ অন্যকে দিলেন। হংকং দেখিয়েছে, রেলের জমি কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। আপনি ভর্তুকি দিতে পারেন, কিন্তু রেলের জমি ব্যবহার করে সেখান থেকে রিটার্ন পাওয়ার ব্যাপক সুযোগ আছে, সেটি করতে পারলেন না।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সম্পদ রয়েছে রেলের। এর সম্পদ ব্যবহার করে রেলের উন্নয়ন সম্ভব ছিল। অথচ রেলের জমি অন্যকে ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। মহাখালীতে রেলের জমিতে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। আর্মিরা রেলের জায়গায় আবাসিক ভবন করছে। ঢাকার কেন্দ্র ফুলবাড়িতে রেলের জায়গায় মার্কেট, দক্ষিণ সিটি ভবন, পুলিশ সদও দফতর নির্মাণ হয়েছে।
কারা এগুলো ক লো, কেন করলো; এর কোনো জবাব নেই। এ সমাজ দায়বদ্ধ নয়। নইলে রেলের এ হাল হতে পারে না। ঢাকার মতো মেগা সিটিতে রেলের উন্নয়ন ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। চীন, জাপান ব্যাপকভাবে রেলের গতি বাড়াচ্ছে। সবাই এ জায়গাতে বিনিয়োগ করছে, গবেষণা করছে; কারণ তারা রেলের ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পেরেছে।
Advertisement
চাহিদা অনুসারে রেলের গতি বাড়ান, ট্রেনের সংখ্যা-বগির সংখ্যা বাড়ান, প্রয়োজনে দোতলা ট্রেন ব্যবহার করেন। রেলের একটি মাত্র রাস্তায় আপনি ক্যাপাসিটি কয়েকগুণ বাড়াতে পারেন, যা সড়কে পারবেন না।
জাগো নিউজ : ঢাকার এমন বিপর্যয় মোকাবেলায় মেট্রোরেল কতটুকু সহায়ক হতে পারে?
সামছুল হক : এসটিপিতে ঢাকার জন্য ছয়টি রূপরেখা ছিল। এর মধ্যে তিনটি সড়ক ভিত্তিক এবং তিনটি রেল ভিত্তিক।
ঢাকায় যে পরিবহন চলে তাকে গণপরিবন বলা যায় না। গণপরিবহনের বৈশিষ্ট্য আছে। আকাশ ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করছে। সড়কেও এমন আয় হতে পারতো। সরকার নিশ্চিয়তা দিলে অন্যরা সেবা দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। সড়কে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য বাইরে থেকে কোম্পানি আসতো।
নিয়ন্ত্রণ নেই বলে সড়কে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। একটিমাত্র কোম্পানি ঢাকার একটি রাস্তায় পরিবহন সেবা দিতে পারলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। সড়কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণপরিবহনের লেনটি আলাদা করে দেয়া হোক, দেখা যাবে দিনে একেকটি পরিবহন মিরপুর থেকে মতিঝিলে ১৫ বার ট্রিপ দিতে পারবে। সরকার সে কৌশল না নিয়ে শত শত বাস নামিয়ে আরো যানজট সৃষ্টি করছে। গণপরিবহন চলার নিশ্চিয়তা দিলে সবাই বাসে চলাচল করতো।
সরকার গণপরিবহন সমস্যার সমাধান না করতে পেরে মেট্রোরেল করতে চাইছে। রাজধানীতে প্রতি ঘণ্টায় হয়ত ২০ হাজার লোক বাসে চলাচল করছে। কিন্তু চাহিদা রয়েছে আরো ৫০ হাজারেরও বেশি, যা যোগান বাস হয়তো আর দিতে পারবে না।
দুর্ভাগ্য হচ্ছে ফ্লাইওভারগুলোর কারণে মেট্রোরেলও আর আগের নকশায় হচ্ছে না। এই শহর এমনিতেই মরে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা ঢোল বাজিয়ে শেষকৃত্যটা করছি। মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ, তেজগাঁও ফ্লাইওভারের কারণে মেট্রোরেল হতে পারবে না। মেট্রোরেলের উৎকৃষ্ট জায়গা হচ্ছে রাস্তার মধ্যখানে। ফ্লাইওভারগুলোও এখন রাস্তার মাঝে চলে এসেছে। ফ্লাইওভার কোনো সমাধান নয়। এগুলো ছোট ছোট গাড়িগুলোকে আরো আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। বাস ফ্লাইওভারে কম ওঠে।
সুতরাং ঢাকাকে বাঁচানোর জন্য ন্যূনতম যে সুযোগটি ছিল, ফ্লাইওভারের কারণে তাও শেষ হয়ে গেছে। ঢাকার মৃত্যু ঘটিয়েছে ফ্লাইওভারগুলো।
গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার হওয়ার পরই মেট্রোরেলের গতি হারিয়েছে। বিআরটি-২ আর হবে না। অর্থাৎ এসটিপিতে সুপারিশকৃত এবং পরীক্ষিত কৌশলগুলোও আর বাস্তবায়ন হতে পারবে না। একমাত্র হতে পারে মেট্রো-৬, যেটি উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত আসার কথা। তাও নানা হোঁচট খেয়ে। বিমান বাহিনীর অযৌক্তিক বাধায় পড়তে হয়েছে এটিকে। আবার গুলিস্তান ফ্লাইওভারের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এসে ঝুলে থাকতে হবে। সঙ্গিহীন হয়ে পড়ে থাকবে।
তিনটি এমআরটি সমন্বিতভাবে করা হয়েছিল। দুটি উত্তর-দক্ষিণ প্রলম্বিত। আরেকটি ছিল রিংয়ের (গোলাকার) মতো। এ রিং দিয়ে সংযুক্ত করার কথা। কিন্তু ফ্লাইওভারের কারণে বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে থাকবে। একশ বছর পর কী হবে তার ওপর গবেষণা করেই খুঁটি নির্মাণ করার কথা। এক মহাখালী ফ্লাইওভারের কারণে সেখানকার রাস্তায় আর কোনো পিলার দেয়া যাচ্ছে না। একটি ওভারপাস করে নাম দিলাম ফ্লাইওভার। এখনো তাই হচ্ছে। কৌশলপত্র দেখলেই বোঝা যাবে, এগুলো আর বাস্তবায়ন করা যাবে না।
জাগো নিউজ : তার মানে ঢাকাকে স্থানান্তর করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই?
সামছুল হক : চাইলেই তো হবে না। স্থানান্তরের জায়গা কই?
জাগো নিউজ : তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী?
সামছুল হক : ভবিষ্যৎ খুব খারাপ। খুব ক্ষীণভাবে বেঁচে আছি। এ কারণেই অনেকে আমাকে নেগেটিভ মানুষ বলে। শুধু ঢাকা শহর নয়, গোটা দেশেরই একই অবস্থা। ক্যান্সারের সেল যেমন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বড় হয়ে মানুষ মারা যায়, তেমনি অনিয়ন্ত্রিতভাবে নগরায়ন করে গোটা দেশের মৃত্যু ঘটানো হচ্ছে। এমন নগরায়নে শুধু পরিবহন সমস্যা নয়, সকল সমস্যা দ্রুত গতিতে বেড়ে যাচ্ছে।
জাগো নিউজ : কিন্তু উন্নয়ন তো থেমে থাকতে পারে না?
সামছুল হক : সবাই উন্নয়নে বিশ্বাসী। কিন্তু কীভাবে টেকসই উন্নয়ন করা যায় সে ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই। সরকার উন্নয়নকে যৌক্তিক বলছে। কিন্তু তিনটি গণপ্রজেক্ট আটকে মগবাজার ফ্লাইওভারকে আমি কোনোভাবেই যৌক্তিক উন্নয়ন বলতে পারি না। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার কোন নকশায় হলো আপনাকে তা দেখতে হবে।
কলকাতার পাশে হুগলি নদীতে কোনো নৌকা নেই। আছে ওয়াটারবাস। আর আমাদের বুড়িগঙ্গায় হাজার হাজার নৌকা চলছে। হুগলি নদী ওয়াটারবাসে পাড়ি দেয়া হয়। এরপর হাওড়া স্টেশনে এসে ট্রেনে। কিছুদূর গিয়ে ট্যাক্সি। যেন হাত মিলিয়ে দেয়া। আর আমাদের এখানে সদর ঘাটে নেমে চোখে সরষে ফুল দেখতে হয়। একশ’ ট্যাক্সি নামালেই উন্নয়ন নয়। পরিকল্পিতভাবে কিছু করতে পারাই হচ্ছে উন্নয়ন।
নৌ মন্ত্রণালয় সদরঘাটে মার্কেট বানাচ্ছে। পোর্ট কর্তৃপক্ষও তাই করছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি মার্কেট বানালে তো অন্যরাও বানাবে। এয়ারপোর্ট বানিয়েই সরকার ক্ষান্ত। সেখানে কীভাবে যাত্রীরা যাবে তার কোনো তদারকি নেই। সিটি কর্পোরেশন নগর পরিকল্পনা না করে মার্কেট বানাচ্ছে। আলোকিত সরকার থাকলে জবাবদিহিতা থাকতো। বাসের রাস্তা নেই, হাঁটার রাস্তা নেই। রাস্তার পাশে সামান্য জায়গা পেলেই দোকান। সিটি কর্পোরেশন চলে গেছে দোকানে, রাজউক চলে গেছে জমিতে আর বিআরটিএ’র চোখ চলে গেছে যাত্রীর পকেটে। এ বিষয়গুলো বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই।
জাগো নিউজ : তার মানে কেনো আশার বাণী নেই?
সামছুল হক : মৃত্যু পথযাত্রী রোগীর আত্মীয়স্বজনকে ডেকে ডাক্তার দুঃখ প্রকাশ করে বলে, রোগীকে বাড়িতে নিয়ে ভালোমন্দ খাওয়াইয়ে একটু আরাম দিন। আর ফেরানো যাবে না। অনেকেই মানতে চায় না। লন্ডন, সিঙ্গাপুরেও নিয়ে যায়। ফেরানো যায় না। ঢাকা নিয়ে আমার গবেষণাও তাই বলে।
সরকার আসে, সরকার যায়। আমলা আসেন, আমলা যান। আমাদের এখানে সরকার এসে প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজের মতো করে ব্যবহার করতে থাকে। এগুলো দাঁড়ায় না। কেনো পরিকল্পনাবিদ বা প্রযুক্তিবিদের মূল্যায়ন হয় না। চীনে কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোতে ১০-এর অধিক ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে। উন্নয়ন মানেই তো প্রযুক্তি, পরিকল্পনা। দুবাইয়ের দিকে তাকান, সেখানে আমেরিকাও বিনিয়োগ করছে। কারণ হচ্ছে সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ্যদের বসানো হয়েছে। তারকা খচিত কোনো সেনা কর্মকর্তা বা প্রিন্সকে বসায়নি। সেখানে যোগ্য ইহুদিরও মূল্যায়ন হচ্ছে। আর আমাদের এখানে অমুক অমুককে খুশি করতে হবে, সুতরাং তাদের কর্মকর্তাদের এই এই পদে নিয়োগ দাও। আর এ কারণে পরিকল্পিত উন্নয়নের ধারেকাছেও আমরা নেই।
জাগো নিউজ : দেশ তো এগিয়েও যাচ্ছে?
সামছুল হক : উন্নয়ন হবেই। তবে সেটা টেকসই কি না, সেটাই দেখার বিষয়। একটি উন্নয়ন আরেকটি উন্নয়নের জট পাকিয়ে দিচ্ছে। সরকার রেলের দুটি ট্রাকের কথা বলছে। ভালো কথা। তাহলে সড়কের কী হবে? রেলের কারণে বাসযাত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে থাকতে হয়। সমন্বিত উন্নয়নই হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন। একটিকে অবহেলা করে আরেকটি অধিক গুরুত্ব পেলে তাকে টেকসই উন্নয়ন বলা যায় না।
এএসএস/এমএআর/এমএস