খেলাধুলা

দুধের শিশু রেখেই খেলতে নামেন কুস্তিগীর মিতু

ফয়সাল ইসলাম ফিহাদের বয়স মাত্র ১০ মাস। মায়ের কোলটাই এখনো যার সবচেয়ে ভরসার জায়গা। কিন্তু ফারজানা শারমিন মিতু ওই দুধের শিশুকে তার দাদীর কোলে রেখে নেমে পড়লেন কুস্তির মাঠে।

Advertisement

ষষ্ঠ সার্ভিসেস কুস্তিতে নিজ ওজন শ্রেণিতে স্বর্ণ জয়ের প্রত্যয় নিয়েই নেমেছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ নারী কুস্তিগীর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি, স্বর্ণের লড়াইয়ে তাকে হারিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ আনসারের লাকি আক্তার। ২০১১ সালের পর এ প্রথম ঘরোয়া কোনো প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ হাতছাড়া হলো টাঙ্গাইলের মেয়ে মিতুর।

মনটা তার ভীষণ খারাপ। হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে তখনও চলছিল বিভিন্ন ইভেন্টের খেলা। মিতু পায়চারি করছিলেন মাঠের পাশে। মাঝে-মধ্যে নিজ সংস্থার খেলোয়াড়দের প্রতিযোগিতার সময় উৎসাহ দিচ্ছেন। কিন্তু মানতে পারছিলেন না অর্ধযুগের শ্রেষ্ঠত্ব হারানোর বেদনা।

‘আসলে বাচ্চা পেটে আসার পর মধ্যে দুই বছর খেলা হয়নি। তারপরও রৌপ্য জেতা আমার জন্য মোটেও ভালো ফলাফল নয়। আমার বাচ্চাটাও হয়েছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। সেটা অবশ্য বড় সমস্যা ছিল না। আমি ওয়েট কমিয়েছি। আশা ছিল স্বর্ণ জয়ের ধারাটা ধরে রাখবো। পারলাম না, দুর্ভাগ্যই বলবো’-বলছিলেন লড়াকু এ নারী কুস্তিগীর।

Advertisement

একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আরশেদ আলীর সঙ্গে ২০১২ সালে জীবনের ঘর বাঁধেন মিতু। খেলা খেলা করেই বিলম্বে মা হওয়া টাঙ্গাইলের এ কুস্তিগীর নারীর। কিন্তু সন্তান পৃথিবীর সোনালি আলো দেখার পর প্রথম প্রতিযোগিতায় সোনাবিহীন কাটলো মিতুর। এ যাত্রায় ছেলের গলায় পদক ঝুলিয়ে সেলফি তোলা হলো না বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর এ সদস্যের।

টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের এ ক্রীড়াবিদ ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন বাংলাদেশ আনসারের জার্সি গায়ে ২০০৮ সালে। শুরুতে খেলেছেন একই সঙ্গে জুডো, বক্সিং, উশু ও কুস্তি। সর্বশেষ বাংলাদেশ গেমসে স্বর্ণ জিতেছিলেন বক্সিং, উশু ও কুস্তিতে।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকে নামের আগে যোগ করেন ‘স্বর্ণ’ শব্দটি। ২০১২ সালে ইন্দো-বাংলাদেশ বাংলা গেমসে রৌপ্য জিতে প্রথম আন্তর্জাতিক সাফল্য পান মিতু। পরের বছরই তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে গ্রহন করেন রাস্ট্রপতি আনসার পদক (সেবা)। সঙ্গে পেয়েছেন এককালীন ৫০ হাজার টাকা।

মিতু পুরোদস্তুর একজন অ্যাথলেট হলেও পরিবারের কেউ সেভাবে জড়িয়ে নেই খেলার সঙ্গে। বাবা আনোয়ার হোসেন অ্যাথলেটিক্স আর ভলিবল খেললেও বেশি দূর যাননি। মিতুর ছোট ৩ বোনের কেউ পা বাড়াননি খেলাধুলার দিকে।

Advertisement

মিতু অন্যসব খেলা বাদ দিয়ে এখন ধ্যান-জ্ঞান করেছেন কুস্তিতে। ভুরিভুরি পদক কুড়িয়ে বাড়াচ্ছেন বাবা-মা আর পরিববারের অন্যদের সুনাম। পুরো পরিবারের গর্বের জায়গা এখন সংসারের বড় মেয়ে।

বিয়ের ২ বছর পর ২০১৪ সালে আনসার ছেড়ে যোগ দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। বাংলাদেশ সেনাবাহনীর প্রথম মহিলা সৈনিক ব্যাজেরও সদস্য টাঙ্গাইলের এ মেয়ে। এ সংস্থার হয়ে অভিষেক আসরেই স্বর্ণ জেতেন পঞ্চম সার্ভিসেস কুস্তিতে। একই বছর ৩১ তম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপেও ৬৩ কেজিতে স্বর্ণ জেতেন সুমি-কালের পরিক্রমায় আনসারের স্বর্ণকন্যা এখন হয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহনীর পদকের খনি।

নিজ সংস্থা প্রসঙ্গে মিতু বলেন,‘আমার ক্যারিয়ার আনসারে শুরু হলেও এখন আমি সেনাবাহিনীতে অনেক ভালো আছি। এখানকার সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। ২২ হাজার টাকার বেশি বেতন তুলি, পাশাপাশি আরো অনেক কিছু। আমার বাবা ব্যবসা করেন। এখন ভালো খেলার জন্য তিনি অনেক প্রেরণা দেন।’

মেয়েদের খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। তবে মিতু নিজেকে তো আর মেয়ে মনে করেন না, ভাবেন একজন খেলোয়াড়। তিনি বলেন, ‘ মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা অনেক কষ্টের। অনেক কঠিন ব্যাপারও। তবে সাহস আর মনোবলই সব কিছু। আমি মেয়ে হিসেবে মনে করিনা। আমিতো খেলোয়াড়। বাবা প্রথমে আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। চাকরি করতে দিতে চাননি। কাকার অবদানে এসেছি। আনসারে চাকরি করলাম। আনসারে ট্রেনিং করে ৪৫৩ জনের মধ্যে চৌকস রিক্রুট হলাম। এখন সেনাবাহিনীতে। আমার সব কিছু ঠিকঠাকই চলছে।’

আরআই/এমএমআর/এমএস