প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত সাহাবাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হজরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহু। ইসলাম গ্রহণে তাঁর ওপর নেমে এসেছে অমানুষিক নির্যাতন। ইসলামের জন্য ত্যাগ স্বীকারকারী এ সাহাবির সংক্ষিপ্ত জীবনালেক্ষ্য তুলে ধরা হলো-
Advertisement
নাম খাব্বাব, পিতা আরাত। তিনি ছিলেন বনু তামিমের সন্তান। অন্য এক গোত্রের আক্রমণে তাঁর গোত্রটি পরাজিত হয়। আক্রমণকারীরা সকল পুরুষদেরকে হত্যা করে এবং নারী ও ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে দাসে পরিণত করা হয়। হজরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন ছোটদের একজন।
হাত বদল হয়ে তিনি পৌঁছেন মক্কার বাজারে। বনু খুজায়া’র উম্মু আম্মার নামের এক মহিলা তাঁকে দাস হিসেবে ক্রয় করে। উম্মু আম্মার তাঁকে কর্মকারের কাজে নিয়োজিত করে। তিনি কয়লার আগুনে লোহা গলিয়ে ঢাল, তলোয়ার ও বর্শা তৈরির কাজ করতেন। তিনি ছিলেন একজন সৎ ও কর্মঠ তরুণ।
মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামক এক ব্যক্তি নতুন দ্বীন প্রচার করছেন জানতে পেরে যুবক খাব্বাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে গেলেন। তাঁর মুখে আল কুরআনের বাণী শুনে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত খাব্বাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) প্রথম পাঁচ ছয়জন ইসলাম গ্রহণকারীর পরেই তিনি ইসলাম গ্রহন করার সৌভাগ্য লাভ করেন।
Advertisement
হজরত খাব্বাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখলেন না। নিঃসংকোচে অন্যদের কাছে দ্বীনের কথা বলা শুরু করেন। কয়েকদিনের মধ্যে এই খবর পৌঁছলো তাঁর মুনিব উম্মু আম্মারের কাছে। উম্মু আম্মার তার ভাই সিবা’ ইবনু আবদিল উয্যা ও আরো কয়েকজনকে নিয়ে খাব্বাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চান। তারা বলে, ‘তুমি নাকি ধর্মত্যাগী হয়ে বনু হাশিমের এক যুবকের অনুসারী হয়েছ?
তিনি বললেন, ‘আমি ধর্মত্যাগী হইনি। তবে ‘লা-শারিক আল্লাহ’-এর ওপর ঈমান এনেছি, মূর্তি পূজা ছেড়ে দিয়েছি এবং সাক্ষ্য দিয়েছি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল।’
আরও পড়ুন
ঈমানের ওপর অবিচল আস্থার অধিকারী হজরত বেলাল আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ : যার তেলাওয়াত শুনে কাঁদতেন বিশ্বনবিতাঁর কথা শেষ হতে না হতেই সিবা’ ও তার সঙ্গীরা নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপর। অনবরত কিল-ঘুষি মারতে থাকে, পা দিয়ে পিষতে থাকে তাঁকে।
Advertisement
একদিন খাব্বাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সান্নিধ্য থেকে তাঁর কর্মস্থলে ফিরে আসেন। সেখানে ছিল একদল লোক। তারা যখন জানতে পেল খাব্বাব রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট থেকে এসেছেন, তারা তাঁকে মারতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে এলে দেখেন তাঁর দেহ ক্ষত-বিক্ষত এবং পোষাক রক্তে-রঞ্জিত।
মক্কার মুশরিক নেতাদের নির্দেশে সিবা’ ইবনু আবদিল উয্যা ও তার সঙ্গীরা হজরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লোহার পোষাক পরিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দিতে থাকে।
প্রচন্ড গরমে তিনি কাতর হয়ে পড়তেন, পিপাসায় ছটফট করতেন। এই অবস্থায় তাঁকে বলা হতো, ‘মুহাম্মাদ (মাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অ সাল্লাম) সম্পর্কে এখন তোমার বক্তব্য কী?
এ নির্যাতনের মধ্যেও তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলতেন, ‘তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নেয়ার জন্য তিনি আমাদের নিকট সত্যের বাণী নিয়ে এসেছেন।’ আবারো শুরু হতো অমানুষিক নির্যাতন।
ইসলাম গহণ করার অপরাধে তার মনিব উম্মে আম্মারের ভাইয়েরা তাকে নিষ্ঠুর নির্যাতন করত। তারা হাপরে কতকগুলো পাথর টুকরো গরম করে সেইগুলো বিছিয়ে এবং উত্তপ্ত আগুন তৈরি করে তার ওপর তাঁকে শুইয়ে দিত এবং একজন বলবান ব্যক্তি তাঁর বুকের ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকত। এই উত্তপ্ত পাথর ও জলন্ত কয়লার আগুনে তাঁর পিঠের গোশত খসে পড়ত, শরীরের রক্ত মাংসগুলো গলে গলে কয়লার আগুন নিভে তা ঠান্ডা হয়ে যেত।
কয়লার আগুনে ঝলসে গিয়ে তার শরীরে এমন গর্ত হয়েছিল যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই গর্তগুলো পূরণ হয়নি। সেজন্য তিনি সব সময় গায়ের ওপর চাদর জড়িয়ে রাখতেন। মাঝে-মধ্যে উম্মু আম্মার দোকানে এসে হাপরে লোহার পাত গরম করে তাঁর মাথায় ঠেসে ধরত, যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করতেন, জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। এত নির্যাতনের পরেও তিনি ইসলাম ত্যাগ করে কুফরে ফিরে যেতে রাজি হননি।
একবার হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতের সময় তিনি খাব্বাব রাদিয়াল্লাহ আনহুর ওপর নির্যাতনের বিস্তারিত জানতে চাইলে হজরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমার কোমরের প্রতি লক্ষ্য করুন।’
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর কোমর দেখে বলেন, ‘হায় একি অবস্থা!’ তখন খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমাকে জ্বলন্ত আগুনের কয়লার ওপর শুইয়ে ধরে রাখা হত, ফলে আমার চর্বি এবং রক্ত প্রবাহিত হয়ে আগুন নিভে যেত। এ ছিল ইসলামের জন্য হজরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর ত্যাগ।
মাত্র ৩৬ বছর বয়সে হজরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যু হয় এবং সাহাবাদের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনিই কুফায় কবরস্থ হন। তাঁর মৃত্যুর পর হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর কবরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলেন, ‘আল্লাহ খাব্বাবের ওপর রহম করুন। তিনি নিজের ইচ্ছায় মুসলমান হয়েছিলেন, হিজরত করেছিলেন, তাঁর জীবদ্দশায় সব জেহাদে অংশগহণ করেছিলেন।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হজরত খাব্বাবের মতো ইস্পতসম দৃঢ় মনোবল ও ইসলামের জন্য যাবতীয় ত্যাগ ও বিসর্জন দেয়ার তাওফিক দান করুন। ইসলামের বিধি-বিধান নিজেদের জীবনে পালন এবং সমাজ জীবনে বাস্তবায়নে দৃঢ়তার ও আত্ম ত্যাগের গুণ অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/পিআর