কৃষি ও প্রকৃতি

জেনে নিন আখ চাষের পদ্ধতি : সপ্তম পর্ব

আখ অর্থকরী ফসলের মধ্যে অন্যতম। আখ থেকে চিনি, গুড় এবং রস পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মোট আবাদকৃত জমির ২.০৫% আখের আবাদ হয় যার পরিমাণ ১.৭০ লাখ হেক্টর। মিলজোনে ০.৮৬ লাখ হেক্টর এবং ননমিলজোনে ০.৮৪ লাখ হেক্টর। আসুন আখ চাষের পদ্ধতি জেনে নেই-

Advertisement

জমিতে পানি সেচ কখন এবং কতদিন পরপর সেচ দিতে হবে তা নির্ভর করে আবহাওয়া, মাটির ধরন, ফসলের বৃদ্ধির হার এবং অবস্থার উপর। বাস্তব অবস্থা এবং নিজ অভিজ্ঞতার নীরিখে চাষিদের এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে কয়েক সপ্তাহ পর পর জমিতে ৪-৫ ইঞ্চি পানি সরবরাহ করলে আখের বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং ফলন ভালো হয়। এভাবে ৩-৪টি সেচ দিলে এবং প্রয়োজনমতো সার ও পরিচর্যা করলে একর প্রতি ফলন ৪০-৫০ টনে বৃদ্ধি করা সম্ভব। বর্ষাকালে আখের জমিতে বৃষ্টির পানি যেন জমে না থাকে সেজন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও করতে হবে।

মুড়িআখ ব্যবস্থাপনাসারা ক্ষেতে সমভাবে সুস্থ-সবল আখের চারা থাকা বাঞ্ছনীয়। চারা তৈরি করে রোপিত আখ জমিকেই মুড়ির জন্য নির্বাচন করা শ্রেয়। কারণ এ ধরনের জমিতে ফলন বেশি পাওয়া যাবে। রোগ পোকামাকড়ের উপদ্রব কম ছিল, এরূপ জমিতে মুড়ি আখের চাষ করা উত্তম।

মুড়িআখ রাখতে করণীয়রেটুন সেভিং আখের একটি গুরূত্বপূর্ণ প্রযুক্তি। আখ অবশ্যই ধারালো কোদাল দিয়ে মাটি সমান এবং সম্ভব হলে একটু গভীরে কাটাই ভালো। কাটার এ পদ্ধতিকেই রেটুন সেভিং বলা হয়।

Advertisement

প্রাথমিক পরিচর্যা আখ কাটার ৫-৭ দিনের মধ্যেই আখের পরিত্যক্ত অংশ পুড়ে, ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার দিয়ে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে। লাভজনক মুড়িআখ আবাদের জন্য বিকল্প প্রযুক্তি হিসেবে জমি চাষের সময় আখের পরিত্যক্ত অংশসমূহ আখের দুই পাশের সারিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এভাবে মাটি উলটপালটের ফলে পরিত্যক্ত অংশ মাটির সঙ্গে মিশে আখের ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে। এই পদ্ধতিতে জমিতে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, আগাছা নিয়ন্ত্রণ হয়, জৈবসার প্রয়োগে মাটির গঠন উন্নত হয় এবং শেকড় থেকে আখের খাবার গ্রহণ সহজ হয়। তবে আখের পরিত্যক্ত অংশসমুহ রোগ-জীবাণুর নিরাপদ আবাসস্থল। অতএব এগুলো জমিতে ব্যবহারের আগে কীটনাশক এবং ছত্রাকনাশক ওষুধ দিয়ে শোধন করে নিতে হবে। এ পদ্ধতিতে পরিত্যক্ত অংশ পোড়ানোর চেয়ে, মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া বেশি কার্যকর হবে।

প্রথম চাষের সময় অঞ্চলভেদে অনুমোদিত মাত্রার সবটুকু ফসফরাস সার, অর্ধেক পটাশ সার মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। মুড়ি রাখার সময় চারা গজানোর জন্য মাটিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে অঞ্চল এবং মাটির ধরনের দিকে লক্ষ্য রেখে অনুমিত মাত্রায় সেচ প্রয়োগ করতে হবে।

পরিচর্যা ফাঁকা জায়গা পূরণের জন্য আগে তৈরি করা চারা পাতার দুই তৃতীয়াংশ ছেঁটে রোপণ করলে চারা সুস্থ ও সবলভাবে বেড়ে উঠবে এবং শেকড়ের ভিত্তি মজবুত হবে। কুশি গজানোর পর্যায়ে গ্যাপ ফিলিং অধিক কার্যকরী হয়। জমিতে আগাছা জন্মালে, আগাছা পরিষ্কার করে সঠিকভাবে চারা রোপণ করতে হবে। স্মাট ও সাদা পাতাসহ রোগাক্রান্ত ঝাড়ের সমস্ত গাছ শেকড়সহ উঠিয়ে ফেলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে অথবা মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে। প্রচলিত এবং রোপা পদ্ধতিতে আখ রোপণে সার প্রয়োগ পদ্ধতি মুড়িআখের বেলায় ও প্রযোজ্য। তবে মুড়িআখে বিঘাপ্রতি ১২.৫ কেজি ইউরিয়া সার বেশি দিতে হবে। ৪-৬ ইঞ্চি গভীরে আখের গোড়ার চারপাশে ইউরিয়া সার প্রয়োগের ফলে মুড়ির ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

পরিপক্কতাআখের পরিপক্কতার জন্য সাধারণত ১০ থেকে ১২ মাস সময় প্রয়োজন। পরিপক্ক আখের গায়ের রং সাধারণত উজ্জ্বল হয়, আখের গায়ে টোকা দিলে ধাতব শব্দ হয়। যে জমি থেকে আখ কাটা হবে ওই জমির কোনো একটি আখ সমান তিন খণ্ড কেটে চিবিয়ে যদি মনে হয় সব খণ্ডই প্রায় সমান মিষ্টি, তাহলে বুঝতে হবে আখে পরিপক্কতা এসেছে। মাঠে দণ্ডায়মান আখে ফুল দেখা দিলে পরিপক্কতা এসে গেছে বলে বুঝতে হবে। এছাড়া যে সব আখ জাতের ফুল হয় না; সেগুলোর পরিপক্কতা বোঝাতে সবুজ পাতার সংখ্যা ১৭-১৮ থেকে ৭-৮ এ নেমে আসলেই বুঝতে হবে আখ পরিপক্ক হয়েছে।

Advertisement

গুড় উৎপাদনআখে নাইট্রোজেন সার ব্যবহার গুড়ের মানের ওপর দারুণভাবে প্রভাব ফেলে। মাত্রাতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার ব্যবহারে রস কম পরিষ্কার হয়, বিধায় গুড়ের রং কালচে হয়ে যায়। এ ধরনের খারাপ রঙের গুড় দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় না। কিন্তু সুষম মাত্রায় ফসফরাস জাতীয় সার ব্যবহারে রস পরিষ্কার করা সহজ হয় এবং গুড়ের মান ভালো হয়। আখের পাতা ছাড়িয়ে গিরা এবং গোড়ার শেকড় ভালোভাবে পরিষ্কার করে গোড়ার মাটি এবং অন্যান্য আবর্জনা পরিষ্কার করে আখ কাটার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাড়াই করা উত্তম। মাড়াইকল, চুলা, কড়াই ও রস পরিষ্কারকই আখ থেকে গুড় তৈরির প্রধান উপকরণ।

মাড়াইলকলবাংলাদেশে ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) কর্তৃক সুপারিশকৃত ৫ রোলারবিশিষ্ট ও দুই স্তরে আখ মাড়াই উপযোগী এবং বর্তমানে প্রচলিত অন্যান্য মাড়াইকল থেকে শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ বেশি রস আহরণ ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তিচালিত (১৬ হর্স পাওয়ার ডিজেল ইঞ্জিন চালিত) আধুনিক মাড়াইকল ব্যবহার করা যেতে পারে। মাড়াইকলটি সহজেই স্থানান্তরযোগ্য, ৪ চাকাবিশিষ্ট ১২ ফুট লম্বা ও ৩.৫ ফুট চওড়া একটি মজবুত লোহার ফ্রেমের উপর স্থাপিত। ঘণ্টায় ১ লিটার ডিজেল লাগে এবং ৫০০-৫৬০ কেজি আখ মাড়াই করা যায়।

চুলাগুড় প্রস্তুতের জন্য সাধারণত বিভিন্ন ধরনের দেশি চুলা ব্যবহার হয়ে থাকে। দেশি চুলার মধ্যে ৭.৫ ফুট ৫ ফুট x ২.৫ ফুট আকারের চুলাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। নাটোর জেলার লালপুর এবং সংলগ্ন এলাকায় অধিক কার্যকর পিটচুলা ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের চুলায় জ্বালানী প্রবেশদ্বারের কাছ ছোট গর্ত থাকে এবং এর ওপর লোহার রড ব্যবহার করে ছাই নিচে পড়ার ব্যবস্থা আছে। কমখরচে গুড় প্রস্তুতের জন্য পিটচুলায় ফ্লু-গ্যাস তাপের কার্যকর ব্যবহার করা হয়। এই চুলায় চিমনি ৪-৫ ফুট দূরে এমনভাবে স্থাপন করা হয়; যাতে চুলার ছাই কড়াইয়ের রসে মিশতে না পারে।

কড়াইআখের রস জ্বাল দেওয়ার জন্য পরিষ্কার এবং আয়রনমুক্ত কড়াই বা প্যান ব্যবহার করা উচিত। গ্যালভানাইজিং করা স্টিলের তৈরি কড়াই ব্যবহার করতে হবে।

এসইউ/এমএস