সম্প্রতি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের বিষয়ে গণমাধ্যমের কল্যাণে আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে যেসব সংবাদ পাচ্ছি তাতে করে দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং উচ্চ উচ্চ বিদ্বান ও জ্ঞানীগুণী শিক্ষকদের সম্পর্কে আস্থাশীল থাকাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রতি আমরা যথাযথ আস্থা রাখতে পারছি না। শুধু উপাচার্যদের ‘আর্থিক দুর্নীতি’ই নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ কিছু শিক্ষকের মধ্যে ‘গবেষণা-দুর্নীতি’ও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আবার সংখ্যায় স্বল্প হলেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দ্বারা নানা পন্থায় ছাত্রী নিপীড়নের খবরও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সাধারণের ধারণাকে দিনদিন নিন্মমুখী করে তুলছে।
Advertisement
সার্বিকভাবে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলোতে এখন অস্থিরতা থাকায় সাধারণ মানুষও পড়েছে বিপাকে। এরকম অস্থিরতা নিয়ে বর্তমানে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় গণমাধ্যমের শিরোনাম দখল করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় দুটি হলো ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। এদুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা যেহেতু এমাসেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা সেহেতু এরকম অস্থিরতা ভর্তিচ্ছুদের অভিভাবকদেরকেও আচ্ছন্ন করেছে। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকগণ একপ্রকার আতংকেও আছেন তাও বলা যায়। উপাচার্যদের ‘আর্থিক দুর্নীতি’র কারণে সৃষ্ট সংকটে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের হতাশাজাত দোলাচলও তৈরি হয়। দেশ গড়ার কারিগর তথা শিক্ষকরাই যদি এমন হয় তবে আমাদের সন্তানরা ভবিষ্যতে কী হবে? শিক্ষকদের আদর্শ অনুসরণ করাইতো শিক্ষার্থীর ধর্ম!
আমাদের দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন শিক্ষকদের মধ্য থেকেই। যে যাই বলুক বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের একটু ‘ভিন্ন চোখে’ই দেখা হয়। এই ‘ভিন্ন চোখ’টি প্রকারান্তরে ও প্রকৃতপক্ষে ‘সম্মানের’ই চোখ। আদিকাল থেকে সমাজে শিক্ষকদেরকে সাধারণ মানুষ একটু আলাদা সম্মান দিয়ে আসছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নেই। নানামুখী সমালোচনা আছে সত্যি, তবু শিক্ষকদের প্রতি সাধারণ মানুষের সম্মান প্রদানে এখনো তেমন ব্যত্যয় ঘটেনি। ভবিষ্যতেও হয়তো শিক্ষকদের প্রতি সাধারণের এই ‘ভিন্ন চোখ’ তথা দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা বদলাবে না।
আগে কেমন ছিল জানি না, তবে বিগত কয়েক বছর যাবৎ গণমাধ্যমের কল্যাণে আমাদের জানা সম্ভব হচ্ছে যে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচর্যের মতো বিভিন্ন প্রশাসনিক পদের (যেমন - প্রো-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ইত্যাদি) দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সর্বসাধারণের সম্মানিত এই শিক্ষকগণ স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে জনবল নিয়োগসহ নানা প্রকারের আর্থিক দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন। আবার ‘আশ্রয়’ নিচ্ছেন বললে বরং ভুলই হবে- বলা যেতে পারে যে, তারা দুর্নীতির ‘পদ্মপুকুরে’ আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে গেছেন। এমনকি স্বল্পদিনের জন্য ‘ভারপ্রাপ্ত’ দায়িত্ব পালনকালেও কোন কোন শিক্ষক এই সুযোগটির হাতছাড়া করতে চাইছেন না। যে কোন সুযোগেই হোক দায়িত্ব পাওয়ার পরপর অনেকের দুর্নীতির প্রসারিত হাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হয়ে ওঠে! জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত এবং ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পালনকালে চাকুরি দেওয়ার নামে অর্থ গ্রহণে মহামান্য ‘রাষ্ট্রপতির আত্মীয়’ পরিচয় পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন! এ নিয়ে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব হলে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির কোষাধ্যক্ষ সাহেবের আত্মীয়তার কোন সম্পর্ক নেই। এই কোষাধ্যক্ষও একদা শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকদের দুর্নীতির এই সৃজনশীলতা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না! আর স্বগতোক্তি করে বলতেই হয় যে, এরকম শিক্ষককুলের ছাত্ররা যখন দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হবেন তখন না জানি তারা কোন কোন আত্মীয়সূত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ধন-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেন! ভয় হয়, ছাত্ররা যদি শিক্ষকের এরূপ ‘আদর্শ’ গ্রহণ করেন!
Advertisement
একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য সাবেক হয়েছেন কবি, লেখক এবং দেখতে শুনতে পরিপাটি এক নিপাট ভদ্রলোক। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় কিংবা আত্মসাতের বিস্তর অভিযোগে তিনিও আক্রান্ত হয়েছেন, অভিযুক্তও হয়েছেন। পত্রিকান্তরে জানা গেল তার নামে রীতিমত মামলাও রুজু হয়েছে ময়মনসিংহের আদালতে! অবশ্য এ সম্পর্কে তার কৌশলী বক্তব্যও আমাদেরকে কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত করে। এটি কি রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়, আত্মসাৎ, দুর্নীতি না কি এটি তার ‘অধিকার’ সে বিষয়ে সাধারণের মতো আমাদের মনেও প্রশ্ন জাগে। যদি প্রমাণিত হয় এটি রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়, আত্মসাৎ কিংবা দুর্নীতি তবে বুঝতে হবে তার এই দুর্নীতি অনেকটাই বুদ্ধিদীপ্ত এবং কৌশলী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছুদিন আগে দায়িত্ব থেকে বিদায় নেওয়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ উপাচার্যের একটি বক্তব্য শুনে রীতিমত ভড়কেই গেলাম! বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত তিনি যে বাংলোতে বসবাস করতেন সেই ‘ভিসির বাংলো’র বিপরীতে সরকারি হারে বাসা ভাড়া কর্তিত হতো না। বরং বেতনের সঙ্গে বাসা ভাড়াও যুক্ত হতো। এ প্রসঙ্গে তার কৌশলী এবং চাতুর্যপূর্ণ বক্তব্য অনেকটা এভাবেই প্রচার মাধ্যমে এসেছে : ‘যেহেতু বাংলোটি তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি তাই ঢাকার বাসা ভাড়া বাবদ তিনি মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত নিয়েছেন।’
আমরা অনেকেই জ্ঞানপাপী শব্দটির অর্থ সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত নই। কিন্তু তার নামে প্রচারিত কর্মকাণ্ড এবং সেসব কর্মকাণ্ডের জন্য আত্মপক্ষ সমর্থনে ভিসি মহোদয় গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে জ্ঞানপাপী শব্দটির অর্থ পরিষ্কার বুঝে ফেলি। এও বুঝি যে, কবি জীবনানন্দ দাশ এদের মত জ্ঞানী ও শিক্ষিতদেরকেই ‘জ্ঞানপাপী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন! একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রধান যদি বলেন তার বসবাসের জন্য নির্মিত বাড়িটি তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি তবে এর চেয়ে হতভম্ব হওয়ার আর কি ঘটনা ঘটতে পারে? আমরা বিস্মিত হই তাহলে বিগত চারটি বছর কীভাবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন পরিচালনা করলেন? আসলে এই দুঃখ বাঙালি জাতির! এই জাতি নির্লোভ, দুর্নীতিমুক্ত, সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সন্তান জন্ম দিতে পারে নি! শুধু সরকারি বাড়ি ভাড়া নয় আর্থিক অনিয়ম এবং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিজের সন্তানকে চাকুরি দেওয়া নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন গণমাধ্যমে এসেছে।
এসব দেখে শুনে মনে হয় সরকার শিক্ষার সুযোগ বিস্তারের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেও প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ই যেন হয়ে ওঠেছে একেকটি দুর্নীতির আখড়া- সেখানের প্রশাসনিক পদে দায়িত্বপ্রাপ্তদের সরকারি অর্থে ‘হরিলুট’-এর প্রতিযোগিতা। বেশ কিছুদিন আগে আমরা রংপুর বেগম রোকেয়া শ্বিবিদ্যালয়েও দেখেছি একই চিত্র। সেখানেও শিক্ষক-উপাচার্যের নামে অভিযোগের অন্ত ছিল না, আন্দোলনের অন্ত ছিল না। সেসব অভিযোগও আদালত পর্যন্ত গড়ায়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সকল কর্মকাণ্ডের বিচার-আচার, সালিশ-নালিশ, থানা-পুলিশ ও আদালতের বারান্দায় বারান্দায় হুমড়ি পড়তে দেখা যায়!
সুতরাং সাধারণ মানুষ বেশ বুঝতে পারে যে, নানা পন্থায়, বুদ্ধিদীপ্ত নানা কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে সরকারি অর্থ অপচয়ের প্রতিযোগিতা। এখন দেশের প্রায় প্রতিটি বড় বড় জেলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্তা তথা ভিসিরা কেউ কারো চেয়ে অন্তত দুর্নীতিতে পিছিয়ে থাকছেন না। তাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েই চরম অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অভিযোগে সেখানকার ছাত্র-শিক্ষকগণ শুরু করেছেন উপাচার্যের দুর্নীতিজাত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী যদি শ্রেণিকক্ষের পাঠ ও গবেষণা কার্যক্রম বাদ দিয়ে দুর্নীতিবাজ উপাচার্যদের বিরুদ্ধেই সময় কাটিয়ে দেয় তাহলে শিক্ষার কী হবে কে জানে? কেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় অধিকাংশেরই ভিসিদের প্রসঙ্গ উঠলে সাধারণ মানুষ ‘ছি ছি’ করবে! কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয় প্রকাশে সাধারণ মানুষ খানিকটা বাঁকা চোখে তাকাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই কোনো কোনোভাবে সাধারণের মধ্যে এই পটভূমি প্রস্তুত করে দিয়েছেন। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষকদেরকেই, শিক্ষক-উপাচার্যদেরকে। উপাচার্য হলেই শিক্ষকের দরিদ্র(!) পরিচয় ভুলে ধনাঢ্য ‘কর্মকর্তা’ হয়ে যেতে হবে এরূপ মানসিকতা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
Advertisement
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জেআইএম