সরাসরি একবারই দেখেছিলাম হুমায়ূন আহমেদকে। নেত্রকোনায় এক নির্বাচনী প্রচারণায় এসেছিলেন। পা ছুঁয়ে সালাম করার সৌভাগ্য হয়েছিল। তা স্মৃতিপটে আজও অমলিন। সে সময় আমার হাতে ছিল স্যারের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বইটি। তিনি দেখে মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘বাবু, আরো সহজ বই আছে। তুমি পড়তে পারবে তো এটা?’ লজ্জা পেয়েছিলাম না কি মনে জেদ চেপেছিল স্মরণ করতে পারছি না।
Advertisement
বইটি সাথে করে বয়ে বেড়ানোর কারণ হলো, সে সময়ে প্রায় অর্ধেক পড়া হয়ে যাওয়ার পরও পুরোটা শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছিল। তাঁর ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’সহ অসংখ্য বই ইতোমধ্যে পড়ে ফেলেছিলাম। প্রত্যেকটি বই-ই পড়ে শেষ করেছি এক বৈঠকে। পড়ার পর মাথাটা শূন্য হয়ে যেত। ঝিম ধরে বসে থাকতাম কিছুক্ষণ। চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি লোপ পেয়ে কেমন এক অজানা শিহরণ জাগত। যা সারা রাত ঘুমোতে দিত না এতটুকুর জন্য। কিন্তু ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাসখানেক ধরে নিয়মিত পড়ার পরও কোথায় যেন আটকে যেতাম। শত চেষ্টাতেও শেষটাতে পৌঁছতে পারতাম না। কেন এমন হয়েছিল?
হুমায়ূন আহমেদ নিজেই বলেছেন, উপন্যাসটি তাঁর অন্যান্য লেখার মতো নয়। অথচ তাঁর চিরাচরিত লিখনশৈলী, উপাদান-উপকরণ থেকে এই উপন্যাসে এর কোনটির অনুপস্থিতিও নেই। তবু কী এক মোহবশে আবিষ্ট রাখার পাশাপাশি এতে পরিলক্ষিত হয়েছে তাঁর বাকি উপন্যাস থেকে স্বতন্ত্র ও অন্য স্বাদের ছাপ।
‘জোছনা ও জননীর গল্পে’ সন্নিবেশিত হয়েছে এক মার্চ থেকে ষোলো ডিসেম্ববর পর্যন্ত। সাত মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, একই মাসের পঁচিশ তারিখ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যা আর ষোলো ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। মাঝখানে নয় মাসের আক্রমণ-প্রতিরোধ মেশানো একেকটি দিন একেকটি রাত। এসব বিবেচনায় ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ এক বিভীষিকাময় উত্তাল কালপর্বকে ধারণ করেছে বলা চলে।
Advertisement
হুমায়ূন আহমেদের সরল লিখনী ও সাবলীল বর্ণনা দেখে অনেক সমালোচক তাঁকে ‘সস্তা’ লেখকের প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেন। অথচ একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, উপন্যাসটিতে বহুসংখ্যক চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েও চরিত্র পরম্পরার দক্ষতা দেখিয়েছেন। সাথে এ উপন্যাসটি রচনার জন্য কী পরিমাণ পরিশ্রম ও গবেষণা তিনি করেছেন তারও স্বাক্ষর পাওয়া যায়। দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের অংশবিশেষ, বেগম সুফিয়া কামালের ডায়েরির স্তবক, বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার সূত্র উল্লেখ করার পাশাপাশি উপন্যাসটির পরিশিষ্টে সংযুক্ত করে দেন সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি হিসেবে ৯৩টি বইয়ের নাম। পাঠককে তিনি পদে পদে জানিয়ে দেন যে, নিছক ফিকশন লিখছেন না তিনি। আবার ইতিহাস রচনাও তাঁর উদ্দেশ্য নয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সার্থক উপন্যাস রচনার প্রয়াসে একবিন্দুও ছাড় দিতে বা নিজের সঙ্গে আপোস করতে তিনি নারাজ।
দুটি চরিত্র বাঙ্গালি কলিমুল্লাহ ও বিহারি জোহরা উভয়েই কবি এবং তাদের অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল। যুদ্ধজয়ের প্রাক্কালে কলিমুল্লাহকে নাটকীয়ভাবে দেখা গিয়েছে স্ত্রীর লাল-সবুজ শাড়ি কেটে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বানাতে। লেখক কী বোঝাতে চেয়েছেন জানি না। তবে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, একজন কবি বা বিবেকবান মানুষের পক্ষে এমন অন্যায় কাজ করা মোটেও সমীচিন হয়নি। বুকের ভেতর থেকে ঘৃণা উপচে বের হয়। অন্তত প্রত্যেক পাঠকের জন্যই এখান থেকে শিক্ষালাভের রসদ আছে।
যুদ্ধ না দেখা হুমায়ূন আহমেদের পাঠকদের জন্য অসাধারণ কাজ করে গেছেন তিনি। তরুণ প্রজন্মের হাতে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাস তুলে দেওয়ার মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্বও পালন করেছেন। নতুনদের কাছে তুলে ধরেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্য, ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশাত্মবোধ ও মানবপ্রেমের প্রেরণা।
এসইউ/জেআইএম
Advertisement