দুর্লভ প্রজাতির পাখি চন্দনা টিয়া, বামুনী কাঠ শালিক, খয়রাপাখ পাপিয়ার, বনসুন্দরী/চামুচা, দাগি ছাতারে, সাইবেরিয়ান চুনীকণ্ঠী, লক্ষী পেঁচা, কমলা বউ, দুধরাজ ও নীল শিসদামারের দেখা মিলছে হরহামেশায়। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে গাং শালিক, বিভিন্ন প্রজাতির চিল, কাঠ ঠোকরা, বসন্ত বৌরী, চড়ুই, জলজ পাখি পানকৌরি এবং ঘুঘু। নিরাপদে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে এই গাছ থেকে সেই গাছ। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার ডেমাজানীতে বৃটিশ শাসক বলিহার রাজার পুরাতন কাচারিবাড়ির শতবর্ষী মেহগনী গাছসহ আড়িয়া বাজার, মানিকদিপা ফায়ারিং রেঞ্জ, জাহাঙ্গীরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বিভিন্ন স্থানে এই বিরল ও দুর্লভ প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যেই স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড ইনভারমেন্ট সেভ টিম (ডাব্লুই.ই.এস.টি) নামের একটি সংগঠন এই এলাকাকে দুর্লভ ও বিরল প্রজাতির পাখির অভয়ারণ্য বলে অভিহিত করেছে। পাশাপাশি বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ রাজশাহীর সহযোগিতায় হৃদয়হীন সৌখিন শিকারীদের প্রতিহত করা, পাখিদের আবাসস্থল রক্ষা ও সংরক্ষণ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
Advertisement
পরিবেশবাদি সংগঠন ডাব্লুই.ই.এস.টির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক বগুড়া সরকারি শাহ্ সুলতান কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এসএম ইকবাল জানান, শাজাহানপুর উপজেলায় বিভিন্ন জাতের প্রাচীন বৃক্ষ ও ঘন ঝোপঝাড় রয়েছে। এখানে বিভিন্ন জাতের শাক-সবজির আবাদ হয়। রয়েছে দুটি সেনানিবাস যা বৃক্ষরাজীতে ভরপুর। এ ছাড়া বাঁশের ঝাড়ের জন্য বিখ্যাত হওয়ায় পাখিদের জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠেছে এই উপজেলা। এ কারণে প্রতিদিন দুর্লভ পাখির সংখ্যা শুধু বাড়ছে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকে ডাব্লুই.ই.এস.টি বগুড়া জেলায় পাখিদের উপর একটি চেকলিষ্ট তৈরি করে। এই তালিকার তথ্য অনুসারে ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত শুধু শাজাহানপুর উপজেলাতেই ৯৩ প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গের অন্য কোনো উপজেলাতেই এত পাখির সমাহার নেই। যার কারণে দুর্লভ প্রজাতির এবং সাধারণ পাখির সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে শাজাহানপুর উপজেলা।
পরিবেশবাদী সংগঠন ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড ইনভারমেন্ট সেভ টিমের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৩ সালের মে মাসে উপজেলার ডেমাজানী বাজারে বাংলাদেশে দুর্লভ বলে বিবেচিত চন্দনা টিয়ার সন্ধান পায় তারা। এরআগে উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাট জেলায় মিলেছিলো এই পাখিটির সন্ধান। তাও আবার ১-২টি নয় ৮টি পাখির। একটি প্রাচীন মেহগনী গাছে বসে ছিলো তারা। স্থানীয় এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় এবং এই সংগঠনটির তত্ত্বাবধানে চন্দনা টিয়া এই এলাকায় এখন বিপদমুক্ত। যার কারণে শতশত টিয়া সারাদিন ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন গাছে। দূর-দূরান্ত থেকে বহু লোক এ পাখি দেখার জন্য চলে আসে। স্থানীয় ব্যবসায়ী মীর ফরিদ, আব্দুল কাদের ও ওবাইদুর রহমান জানান, আমরা এটিকে এলাকার আশীর্বাদ মনে করি। যার জন্য সবাই চেষ্টা করি পাখিগুলোর আবাসস্থল যাতে নষ্ট না হয়।উপজেলার ডেমাজানী বাজারের আশে পাশে রয়েছে দুর্লভ পাখি বামুনী কাঠ শালিক। রাজশাহী জেলার কিছু এলাকা ব্যতিত এ পাখি আর কোথাও পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালে ডাব্লুই.ই.এস.টির চেকলিস্ট তৈরির সময় ডেমাজানী বাজার থেকে শুরু করে আড়িয়া বাজার ও মানিক দিপা এলাকায় প্রথম দেখা পান খয়রাপাখ পাপিয়ার। এ পাখি বাংলাদেশের দুর্লভ অতিথি পাখি। এরা ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর মে-আগস্ট মাস পর্যন্ত এ এলাকায় অবস্থান করে এবং চুপিসারে অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। এই নির্দিষ্ট এলাকা ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে এদের পাওয়া যায় না।
২০০৬ সালে মানিক দিপা গ্রামে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্টের ফায়ারিং রেঞ্জে বন সুন্দরী পাখির সন্ধান পাওয়া যায়। তিন-চার জোড়া পাখি ফায়ারিং রেঞ্জ এলাকায় প্রতি বছর এপ্রিল মাসে আসে। এখানেই প্রজনন করে আগস্ট/সেপ্টেম্বর মাসে চলে যায়। বনসুন্দরী/ চামুচা পাখির উপর ডাব্লুই.ই.এস.টির লাইফ ভিডিও চিত্র সংরক্ষণ রয়েছে। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে জাহাঙ্গীরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পশ্চিমে এক পুকুরে মেঘহও মাছরাঙার সন্ধান পাওয়া যায়। এ পাখিও বাংলাদেশে দুর্লভ। রাজশাহী ও নওগাঁতে এ পাখির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো। এ মাছরাঙা পাখি ডাকে ‘কে-এ-কে-কে-কে’ বলে। কেউ যদি এদের ডাকের সাথে পরিচিত না হয়ে থাকে তবে এদের ডাকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তাকে। মনে হবে কেউ যেন বলছে কে-কে-কে। মাছরাঙা পাখিদের মধ্যে এ পাখি দেখতে খুবই সুন্দর এবং আকারে বেশ বড়।এছাড়া মানিক দিপা গ্রামের পশ্চিম এলাকায় সন্ধান মিলেছে দাগি ছাতারে। এটিও বাংলাদেশের দুর্লভ পাখি। দেখতে অনেকটা ছাতারে পাখির মতোই। ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে ছাতারে থেকে এদের সহজে আলাদা করা যাবে না। এদের ডাক শুনে মনে হবে ক্ষেতের মধ্যে মুরগির বাচ্চা মা হারিয়ে ডাকছে টিউ-টিউ-টিউ। এরা শিম, বরবটি এবং করলার আবাদি জমির পোকা মাকড় খায়। ডাব্লুই.ই.এস.টির অনুসন্ধানী দল বগুড়ার সারিয়াকান্দী উপজেলার মথুরা পাড়া গ্রামে চর সংলগ্ন ঝাউ বনে আরো এক ঝাক দাগি ছাতারের সন্ধান পায়। এছাড়া গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে মানিকদিপা দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে একটি পুকুর পাড়ের জঙ্গলে সন্ধান পাওয়া যায় বিরল পরিযায়ী সাইবেরীয়ান চুনীকণ্ঠী পাখির। ২০১৫ সালের ২৮ মার্চ প্রায় ডাব্লুই.ই.এস.টির চেকলিস্টে অন্তর্ভূক্ত হয় লক্ষী পেঁচা। উপজেলার সাজাপুর ফটকি এলাকার পূর্বের গ্রামে পাওয়া এই দুলর্ভ লক্ষী পেঁচা দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া কমলা বউ, দুধরাজ, নীল শিসদামার মতো আরো দুর্লভ প্রজাতির পাখি চেকলিস্টে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। সাধারণ পাখিদের রয়েছে প্রচুর সমাগম। গাং শালিক, বিভিন্ন জাতের চিল, কাক, শালিক, কাঠ ঠোকরা, বসন্ত বৌরী, চড়ুই, বিভিন্ন জাতের বক, জলজ পাখি পানকৌরি, বিভিন্ন জাতের ভরত, কোকিল এবং অসংখ্য ঘুঘুসহ অন্যান্য সাধারণ পাখির সমারোহ রয়েছে শাজাহানপুরের বিভিন্ন গ্রামে।
Advertisement
ডাব্লুই.ই.এস.টির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এসএম ইকবাল জানান, ইদানিং কিছু হৃদয়হীন লোক এসব পাখি অবাধে শিকার করছেন। এই শিকারীদের প্রতিহত করা এবং পাখিদের রক্ষার জন্য তার সংগঠন গ্রামাঞ্চলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে হট স্পট ও বিরল/দুর্লভ পাখিদের আবাসস্থল এলাকায় সংগঠনের শাখা খুলে স্থানীয় লোকদের টিমভুক্ত করে পাখি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।এমএএস/আরআইপি