রামু, নাসিরনগরের পর আবার আগুন জ্বললো রংপুরের গঙ্গাচড়ায়। এবারও টার্গেট সংখ্যালঘুরা। এবারও ধর্মীয় অবমাননার ভার্চুয়াল অভিযোগ, কিন্তু আগুন জ্বললো অ্যাকচুয়াল। পুড়ে গেল হিন্দুদের ঘরবাড়ি। আসলে নিছক কিছু ঘর বা অবকাঠামো নয়; পুড়ে গেল তাদের স্বপ্ন, আজন্মলালিত আস্থা।
Advertisement
ফেসবুক একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এর কোনো সম্পাদক নেই, কোনো জবাবদিহিতা নেই, নেই কোনো দায়বদ্ধতাও। কেউ ধর্মীয় অবমাননাকর কিছু লিখলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু লেখার আগে তো আর ফিল্টার করার সুযোগ নেই। তাই কোটি ফেসবুকারের কে, কখন কী লিখছে; তা মনিটর করার আসলেই কোনো সুযোগ নেই।
রামু, নাসিরনগরের মত গঙ্গাচগড়ার ঘটনাও ঘটেছে একজন ব্যক্তির ফেসবুক স্ট্যাটাসকে ঘিরে। অভিযোগ সত্য না মিথ্যা তা যাচাই করে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু একজন ব্যক্তির স্ট্যাটাসের দায়ে পুড়ে যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরপরাধ মানুষের ঘরবাড়ি। রামুর ঘটনায় উত্তম বড়ুয়া নিজে কোনো স্ট্যাটাস দেননি। আরেকজন একটি আপত্তিকর স্ট্যাটাসে তাকে ট্যাগ করেছিল। তার নাম যেহেতু উত্তম বড়ুয়া, তাই পুড়েছে বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি, মন্দির।
নাসিরগরে রসরাজ নামে একজন অশিক্ষিত জেলের ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছিল। নামটি যেহেতু রসরাজ, তাই নাসিরনগরে পুড়লো হিন্দুদের ঘরবাড়ি, মন্দির। অথচ পরে জানা গেল, এই স্ট্যাটাস দেয়ার সময় রসরাজ মাছ ধরতে গিয়েছিলেন এবং তার পক্ষে এ ধরনের স্ট্যাটাস দেয়া সম্ভবই না। রামু এবং নাসিরনগরে যা ঘটেছে; তা নিছকই হুজুগ। চিলে কান নিয়েছে শুনে নিজের কানে হাত না দিয়ে সবাই দৌড়েছে চিলের পেছনে। তবে একটা মহল সুপরিকল্পিতভাবে চিলে কান নেয়ার গুজবটি ছড়িয়েছে, মানুষকে উত্তেজিত করেছে। গঙ্গাচড়ায়ও তাই ঘটেছে।
Advertisement
যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই টিটু রায়ের বাড়ি গঙ্গাচড়ায় বটে, কিন্তু ১০ বছর ধরে তিনি নারায়ণগঞ্জে চাকরি করেন এবং সপরিবারে সেখানেই থাকেন। টিটু রায় কী লিখেছেন, আমি জানি না। ধরে নিচ্ছি, তিনি খুবই আপত্তিকর, ধর্মীয় অবমাননাকর কিছুই লিখেছেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছিল, টিটু রায়কে গ্রেপ্তারের চেষ্টাও করছিল। কিন্তু তর সয়নি অনুভূতিওয়ালাদের। পুলিশের ওপর আস্থা না রেখে পবিত্র জুমার দিনে হামলা করা হলো হিন্দুদের ঘরবাড়িতে। এখন জানা যাচ্ছে, হামলার আগে ৫ দিন ধরে সেখানে উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছিল। পুলিশের উচিত ছিল আরো আগেই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া, দ্রুত টিটু রায়কে আইনের আওতায় আনা।
পুলিশের দেরির কারণেই ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। তবু পুলিশ হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করেছে। তাতে ঘটেছে আরো দুঃখজনক ঘটনা। পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন একজন, আহত হয়েছেন পুলিশসহ বেশ কয়েকজন। প্রতিটি মানুষের জীবনই মূল্যবান। পুলিশের গুলিতে যিনি মারা গেলেন, তার জীবনের দামও সমান।
তবে এখন জানা যাচ্ছে, মূল স্ট্যাটাসটি ইসলামী আন্দোলনের এক নেতার। টিটু নামে একজন সেটি শেয়ার করেছিলেন মাত্র। আর শেয়ার করা টিটু, আর অভিযুক্ত টিটু রায় একই ব্যক্তি কিনা সন্দেহ আছে তা নিয়েও। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের আশায় জামায়াতের নেতাকর্মী এই হামলার পরিকল্পনা করছিল।গঙ্গাচড়ায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করে, আগুন দিয়ে আমরা মুসলমানরা বু্ঝিয়ে দিলাম, আমরা মুসলমান, আমরা সংখ্যায় বেশি, তাই আমাদের জোরও বেশি। তোমরা হিন্দু। এ দেশ তোমার নয়।
আমি একটা জিনিস বুঝি না, নিরপরাধ মানুষের ঘরে আগুন দিয়ে আমরা ইসলামের কোন উপকার করলাম? পবিত্র জুমার দিনে আমরা কোন পুণ্য অর্জন করলাম। আমি জানি, আমার ধর্ম, আমার অনুভূতি এত ঠুনকো নয়; যে কেউ একজন ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলেই সেটা ধ্বসে পড়বে। আমার ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ অবমাননাকর কিছু বললে বা লিখলে আমি অবশ্যই তার প্রতিবাদ করবো, প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেবো। কিন্তু আইন হাতে তুলে নিয়ে কারো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়াটা প্রতিবাদ নয়, দুর্বৃত্তপনা। এতে ইসলামের কোনো উপকার হয় না, বরং এই দুর্বৃত্তদের কারণে শান্তির ধর্ম ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, বদনাম হয়।
Advertisement
এই দেশে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। তাই আমাদের দায়িত্ব অন্যদের আগলে রাখা, নিরাপত্তা দেয়া। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যদি আমি তাদের জীবন পুড়িয়ে দেই, তাহলে আমরা ভালো মানুষ নই, ভালো মুসলমান তো নয়ই। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এ দেশের মানুষ ধর্মীয় সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করে। পাশাপাশি মিলে মিশে ধর্ম পালন করে। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মপ্রাণ; তবে সাম্প্রদায়িক নয়। কিন্তু সব ধর্মেই কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষ আছে। কিছু কিছু মানুষ ধর্মকে অবমাননা করে সাধারণ মানুষকে উস্কে দেয়। আবার কিছু কিছু মানুষ মাশরাফির সাথে শুভাশিষের বেয়াদবিতেও সাম্প্রদায়িক গন্ধ খুঁজে পান।
গঙ্গাচড়ায় পোড়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অমুন্য রায়ের প্রশ্ন, ‘কোন জায়গায় কী হলো, ফেসবুক নামের কোন জাগার কে কে লেখিল, হামরা এগুলোর কিছুই জানি না। হামার ঘর মানুষজন আসি কেনে পুড়ি দেলে?’ এই প্রশ্নের কী জবাব দেবো আমরা। লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়।
একজন মুসলমান হিসেবে আমি গঙ্গাচড়ায় ঘরপোড়া মানুষের কাছে করজোরে ক্ষমা চাইছি। প্লিজ আপনারা এই দুর্বৃত্তদের বাংলাদেশ ভাববেন না। বাংলাদেশে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক মানসিকতার মানুষের সংখ্যা কম। কিন্তু সংখ্যায় কম এই মানুষগুলো সুযোগ বুঝে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে উস্কানি দিয়ে মাঠে নামায়। ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা চালায়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সব ধরনের ধর্মীয় অবমাননার প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে ধর্মের নামে সব ধরনের দুর্বৃত্তপনার বিরুদ্ধে।
এই দেশ যতটা আমার, ততটাই অমুন্য রায়ের। আমরা সবাই মিলেমিশে দেশকে এগিয়ে নেবো। কেউ কারো ধর্ম পালনে বাঁধা দেবো না। কেউ কারো ধর্ম নিয়ে উস্কানি দেবো না।
১১ নভেম্বর, ২০১৭probhash2000@gmail.com
এইচআর/এমএস