বিশেষ প্রতিবেদন

আমিষের যোগানে শীর্ষে পোল্ট্রি খাত

দেশে পাঁচ বছরের শিশুদের বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম। আমিষের অভাব এর অন্যতম কারণ। আমিষের ঘাটতি রয়েছে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রাণিজ আমিষ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ ঘাটতি মেটাতে পোল্ট্রি শিল্প রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের ক্রম ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের আমিষের যোগানে একমাত্র উৎস এখন পোল্ট্রি মুরগির ডিম ও মাংস।

Advertisement

মাত্র কয়েক দশক আগেও দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে ডিম বা মুরগি তেমন সহজলভ্য ছিল না। তবে আশির দশকের শুরুতে দেশে ফার্ম বা পোল্ট্রি মুরগি পালন ও ডিমের উৎপাদন শুরু হয়। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকতে এর পরিধি। অল্প সময়েই ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির মাংস ও ডিম দেশের মানুষের অন্যতম প্রধান খাবারের জায়গা করে নিয়েছে।

মানুষের আমিষের চাহিদা মেটাতে শীর্ষে রয়েছে পোল্ট্রি শিল্প। বর্তমানে গরু, মহিষ, খাসি কিংবা ভেড়ার মাংসের দাম অনেক বেশি, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এ অবস্থায় স্বাভাবিক ও সাধ্যের মধ্যে রয়েছে শুধু পোল্ট্রির মাংসের দাম। ফলে আমিষের দৈনন্দিন চাহিদার সিংহভাগই পূরণ করছে এ খাত।

জানা গেছে, সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার ছোট-বড় খামার আছে। এসব খামার থেকে দৈনিক মুরগির মাংসের উৎপাদন হয় প্রায় এক হাজার ৮৫১ টন। এ হিসাবে বছরে মাংস উৎপাদন হয় ছয় লাখ ৭৫ হাজার ৬১৫ টন। যা দেশের মোট মাংসের চাহিদার সিংহভাগ।

Advertisement

এ প্রসঙ্গে মৎস ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জাগো নিউজকে বলেন, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পোল্ট্রি খাত বিশেষ ভূমিকা রাখছে। দেশে যে পরিমাণ মাংসের চাহিদা, এর সিংহভাগের যোগান আসে এ খাত থেকে। পোল্ট্রির ব্যাপক প্রসারের কারণে কম মূল্যে মানুষ দৈনন্দিন আমিষের চাহিদা মেটাতে পারছে।

তিনি বলেন, একজন মানুষের শরীরে গড়ে ৬০ গ্রাম করে মাংসের প্রয়োজন। কিন্তু গরু বা খাসির দাম একটু বেশি হওয়ায় ইচ্ছা করলে সে চাহিদা পূরণ করা যায় না। এটা ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু মানুষ আমিষের চাহিদা ঠিকই পূরণ করতে পারছে। কেননা পোল্ট্রি খাতের বিপ্লবের কারণে কম দামে মুরগির মাংস কিনতে পারছে সাধারণ মানুষ।

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা মৎস্য ও পোল্ট্রি শিল্পে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি। সামনে আরও ভালো করতে চাই। এজন্য উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে এখন গরুর মাংসের কেজি ৫০০ টাকার ওপরে। খাসির মাংস কেজি ৭৫০ টাকা, হাঁস ও অন্যান্য পাখির মাংসের দামও অনেক বেশি। এক্ষেত্রে পোল্ট্রি মুরগির মাংস ১২০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা দরে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে সাধারণের কাছে দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে।

Advertisement

পোল্ট্রি শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল’ সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর বাড়ছে মুরগির মাংসের উৎপাদন। ২০১৪ সালে দেশে মুরগির মাংসের উৎপাদন ছিল পাঁচ লাখ ৫১ হাজার টন, ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ লাখ ৭৪ হাজার টনে এবং ২০১৬ সালে উৎপাদনের এ হার আরও বেড়ে দাঁড়ায় ছয় লাখ ৭৫ হাজার টনে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে হারে পোল্ট্রির মাংসের উৎপাদন বাড়ছে তাতে দেশের মোট চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। তথ্য অনুসারে ২০২১ সাল নাগাদ দেশে মোট মুরগির মাংসের দরকার হবে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টন। এ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে এ খাত।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের সভাপতি মসিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মুরগির মাংসের চাহিদা পূরণে আমরা বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখছি। কিন্তু এতে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। কারণ মাছ ও মাংস মিলে প্রাণিজ আমিষ খাওয়া দরকার বছরে অন্তত ২৫-৩০ কেজি। কিন্তু আমরা খাচ্ছি ২৩ কেজি (মাংস আট কেজি, মাছ ১৫ কেজি)। সে হিসাবে মাংসের পরিমাণ কম। উন্নত বিশ্বের মানুষ বছরে গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ কেজি মাংস খেয়ে থাকেন। এ হিসেবে চাহিদা পূরণে আমাদের আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে এ খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়াতে হবে। কমাতে হবে পোল্ট্রিফিডের দাম। এ জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও সহযোগিতা জরুরি।

শুধু মাংসের চাহিদা নয়, দেশের মোট ডিমের চাহিদাও পূরণ হচ্ছে এ খাত থেকে। তথ্য অনুসারে, দেশে প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে দুই কোটি ২০ লাখ থেকে ২৫ লাখ। ফলে বাজারে ডিমের দাম এখনও নাগালের মধ্যে রয়েছে। আমিষ ও পুষ্টির চাহিদা মেটাতে দেশে পোল্ট্রি খাতের ভূমিকা প্রশংসনীয় বলে মনে করেন পুষ্টিবিদরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, দামের কারণে প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠী ইচ্ছা করলেই গরুর মাংস খেতে পারেন না। খাসির মাংস তো ছোঁয়াই যায় না। এক্ষেত্রে গ্রামগঞ্জের মানুষ এক সময় বাড়িতে পালন করা মুরগি ও ডিমের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু এখন গ্রামগঞ্জে হাঁস-মুরগির পালন কমে গেছে। এ অবস্থায় মানুষ এখন ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। আমিষের চাহিদা পূরণ করতে হলে বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের আরও বিকাশ অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

উল্লেখ্য, আশির দশকে এ শিল্পে দেশে মোট বিনিয়োগ ছিল এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমানে এ খাতে বিনিয়োগ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকারের সহযোগিতা পেলে ২০২০ সাল নাগাদ বিনিয়োগ হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। সেইসঙ্গে প্রায় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এছাড়া দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি মুরগির মাংস ও ডিম রফতানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।

এমএ/এসআর/এমএআর/বিএ/আরআইপি