দেশজুড়ে

ভেলায় ভেসে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ থেমে নেই

নৌকার চেয়ে এবার প্লাস্টিকের জারিকেন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি ভেলায় ভরসা বাড়ছে ওপারে থাকা রোহিঙ্গাদের। রাখাইনের দক্ষিণ পশ্চিম এলাকার নাইক্ষদিয়া ও ধাওনখালী এলাকার রোহিঙ্গারা ঝুঁকি নিয়ে নাফ নদ পার হচ্ছে। গতকাল বুধবার ভেলায় চড়ে ৫২ রোহিঙ্গা নিরাপদে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারায় বৃহস্পতিবার ফের ভেলায় ভেসে এপারে এসেছে ১৩২ জন রোহিঙ্গা। এতে গত দুদিনে ভেলায় ভেসে ১৮৬ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে।

Advertisement

এছাড়ও দুটি নৌকায় পৃথকভাবে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে এসেছে ১৬২ রোহিঙ্গা। শাহপরীদ্বীপ এলাকা থেকে বিজিবি তাদের নিজেদের আয়ত্বে নেয়। সব মিলিয়ে ভেলায় ও নৌকায় একদিনে বাংলাদেশে আসে ২৯৪ রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষ।

নতুন আসা রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে বিজিবি জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তারা রাখাইনের ধাওনখালী চর থেকে রওনা দেয়। প্রায় চার ঘণ্টা নাফ নদে ভেসে বেলা ১১টার দিকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জেটি ঘাটে পৌঁছে ৭০ জনকে বহনকারী ভেলা। এর আধা ঘণ্টার ব্যবধানে অপর একটি ভেলায় করে ৬০ জন রোহিঙ্গা জালিয়া পাড়ায় পৌঁছে। পৃথকভাবে আরও ২ যুবক প্লাস্টিকের জারিকেন নিয়ে সাঁতরে শাহপরীর দ্বীপ জেটি ঘাটে আসে।

সব মিলিয়ে ৬১ শিশু, ৪০ নারী ও ৩১ পুরুষ রয়েছে ভেলায় আসাদের মধ্যে। এ সব রোহিঙ্গাদের স্থানীয় বিজিবি উদ্ধার করে নিজেদের হেফাজতে নেয় এবং রাতেউ তাদের বালুখালী ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হবে।

Advertisement

একইদিন ভোর রাতে নৌকায় শাহপরীর দ্বীপ জালিয়া পাড়া সীমান্ত দিয়ে ঢুকার চেষ্টা কালে শাহপরীর দ্বীপ বিওপি বিজিবি টহলদল ১৬২ রোহিঙ্গাসহ দু’টি নৌকা জব্দ করে। এতে ৮৩ শিশু, ৪১ নারী ও ৩৮ পুরুষ রয়েছে। সব মিলিয়ে ২৯৪ জন রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষ হেফাজতে নেয় বিজিবি।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ বিওপি বিজিবির কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল জলিল জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হেফাজতে নেয়া রোহিঙ্গাদের তল্লাশি শেষে ক্যাম্পে নেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।

ভেলায় চড়ে আসা রাসিদংয়ের সাইদং এলাকার বাসিন্দা হোসেন শরীফ জানান, রাখাইনের বুচিদং ও সিন্দিপ্রাং এলাকা থেকে তারা এসেছেন। রাখাইনে সেনাদের চাপের মুখে ঘরে বন্দী জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে তারা প্রায় এক মাস আগে ঘর ছেড়ে রাখাইনের ধাওনখালী চরে এসে অবস্থান নেন। কিন্তু সেখান খাদ্যভাব দেখা দেয়ায় বাংলাদেশ আসতে চেষ্টা চালান। কিন্তু নৌকা বা কোনো বাহন না পেয়ে তারা হতাশ হয়ে যান। এর আগেও ৬১ যুবক জারিকেন বুকে নাফ নদ সাঁতরে নিরাপদে বাংলাদেশে ঢুকেছে এটি জানার পর সবাই মিলে নাফ নদ পাড়ি দিতে ভেলায় ওঠেন।

তার সঙ্গে আসা একই এলাকার জহুরা খাতুন বলেন, সেনা ও মগদের অনাচারে বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে নদীর তীরে এসে অর্ধাহার-অনাহারে বাস করেছি। ক্ষুধার যাতনা বাড়তে থাকায় নিরুপায় হয়ে ভেলায় চেপে নদী পার হলাম। বেশ কয়েক ঘণ্টা শুধু আল্লাহর নাম জপেছি। মনে হচ্ছিল এ বুঝি ডুবে গেলাম!

Advertisement

সিনদং এলাকার হাসান বলেন, সেনারা ঘরবাড়ি থেকে বের হতে দিচ্ছে না। ক্ষেতের ধান কাটতে বাধা দিচ্ছে। বাজারে যাওয়া ও স্বাভাবিক চলাচলেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। কিছু বলতে গেলেই ‘এনভিসি কার্ড’ নিতে বাধ্য করে। সেই কার্ডধারীরা অবৈধ অভিভাসী হিসেবে শনাক্ত। সব হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্তরা চরম অসহায়ত্ব নিয়ে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে নাফ নদ পার হয়েছি।

ধাওয়ানখালী চরে ১৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার অপেক্ষায় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, খাদ্যের মজুদ যা ছিল তা শেষ হয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে নানা বালাই (অসুখ)। অসুস্থ শিশু ও মা-বোন মাঠিতে গড়া গড়ি খাচ্ছে। সপ্তাহ-পনেরদিন ধরে কোনো নৌকা এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। প্রায় ২০ দিন আগে দু’একটা নৌকা ধাওনখালী সীমান্তে গেলেও অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করায় কেউ নৌকায় ওঠেনি। অনেক যুবক সাঁতরে এসেছিল, তবে নারী ও শিশুদের কথা ভেবে ভেলা বানিয়ে এপারে আসার উদ্যোগ নিয়েছি।

টেকনাফ বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম বলেন, ভেলায় আসা রোহিঙ্গাদের রাতে বালুখালী ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। জারিকেন ও বাঁশের সহায়তায় ভেলা বানিয়ে এতো নারী-শিশুর এভাবে নদী পার হওয়া উদ্বেগজনক। মানবিক কারণে কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

সায়ীদ আলমগীর/আরএআর/আইআই