হবিগঞ্জ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় মেতে উঠেছে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগটি। বছরের পর বছর ধরে নিরবেই চলছে এমন অনিয়ম। এতে ঠিকাদার আর প্রকৌশলীদের যোগসাজেশ রয়েছে অটুট। ফলে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলে কেউ তেমন কিছু করতে পারেন না। কখনো আবার উভয়ে মিলে নানা কৌশলে প্রতিবাদকারীকে বাগে আনে। সম্প্রতি এমন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে মাধবপুর উপজেলার মনতলা শাহজালাল কলেজের ভবন নির্মাণ কাজে।কার্যাদেশের তথ্য থেকে জানা যায়, এ কলেজে চারতলা ফাউন্ডেশনের দু`তলা একটি ভবন নির্মাণের কাজ দেয়া হয়েছে হবিগঞ্জ শহরের ইনাতাবাদ এলাকার মেসার্স মো. আব্দুল আওয়াল নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে। ভবনটির দৈর্ঘ্য ৯৯ ফুট এবং প্রস্থ ৩৩ ফুট ধরা হয়েছে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯শ টাকা। এর মধ্যে ভবন নির্মাণে ১ কোটি ২১ লাখ ৪৩ হাজার ২শ, স্যানেটারি ও পানি ব্যবস্থাপনায় ৫ লাখ ৭৫ হাজার এবং বৈদ্যুতিক কাজের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৩১ হাজার ৭শ টাকা। নির্মাণের সময়কাল রাখা হয়েছে ১৮ মাস। বেসরকারি কলেজ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ কাজটি দেয়া হয়। আর কার্যাদেশ দেয়া হয় ২০১৩ সালের ২৭ জুন।সরেজমিনে জানা যায়, কার্যাদেশ পাওয়ার পর থেকেই ঠিকাদার কাজ শুরু করেন। একতলার ছাদ ঢালাই করে তিনি দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ করে ফেলে রাখেন। সম্প্রতি আবারো ভবনটির দ্বিতীয় তলার কাজ শুরু করেন ঠিকাদার। ১৭ জুন দ্বিতীয় তলার ছাদ ঢালাই করা হয়। ছাদের বিভিন্ন স্থানে রড অধিকতর কম দেয়ার অভিযোগ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ছাদের ঘনত্ব দেয়ার কথা প্রায় সাড়ে ৪ ইঞ্চি। কিন্তু তাও কম দেয়া হয়েছে। ঘনত্ব এমন হয়েছে যে, ছাদের চারপাশে ও উপরের বিভিন্ন স্থানে রড ঢালাইয়ের উপরে উঠে রয়েছে। বিদ্যুতের তার টানার জন্য বসানো পয়েন্টও ছাদের ঢালাইয়ের নীচে যায়নি। তার পুরোটাই উপরে উঠে আছে। ২১ জুন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ছাদের মাঝখানে কয়েকটি অংশে উপর থেকে পানি ঢালতে থাকলে নিচে থেকে দেখা যায় অঝরে পানি পড়ছে। যেন মনে হতে পারে কেউ ছাঁকনি দিয়ে পানি ঢালছেন। ফ্যাকাসে সাদা হয়ে গেছে পুরো ছাদ। এমন অনিয়মের প্রতিবাদে দফায় দফায় বিক্ষোভ করেছেন কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের এ বিক্ষোভে ক্ষুব্ধ হয়ে ঠিকাদার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন বলেও তারা অভিযোগ করেন।কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ফাজিয়া আফরিন লিজা জাগো নিউজকে বলেন, এ ভবনের কাজ অত্যন্ত নিম্নমানের হয়েছে। যদি এখানে ক্লাস হয়, তবে যেকোনো সময় ছাদ ভেঙে অনেকের প্রাণহানী হতে পারে। তাই আমরা এটি পুননির্মাণের দাবি জানাচ্ছি।একই শ্রেণির ছাত্রী জুনাকি আক্তার জুমু জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের কলেজের এ বিল্ডিংয়ের কাজ এমন নিম্নমানের করা হয়েছে, যেখানে আমাদের পক্ষে ক্লাস করা সম্ভব নয়। এ ছাদ যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।কলেজের ছাত্র আব্দুল আওয়াল জাগো নিউজকে জানান, ছাদ ঢালাইয়ের পর দিন কলেজে এসে তারা ছাদে গিয়ে অসংখ্য রড উপরে ভেসে উঠে থাকতে দেখেন। এতে তারা কিছুটা হতবাক হন। তাদের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়, ছাদের ঢালাই হয়েছে, কিন্তু রড দেখা যাচ্ছে কেন? তিনি বলেন, নীচে এসে দেখি ছাদ থেকে পানি ঝড়ছে। এভাবে ৪ দিন পর্যন্ত পানিই পড়েছে। ছাদের কাজের কংক্রিটগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে সংযোগ হয়নি। এটি স্পষ্ট দেখা যায়।ছাত্র শেখ সাগর আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, কংক্রিটের গুড়া দিয়ে বিল্ডিংয়ের ঢালাই করেছে। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছাত্রছাত্রী আন্দোলন করলে ঠিকাদার তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমরা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও বিল্ডিংয়ের মানসম্পন্ন কাজের দাবি জানাই।কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ১৭ জুন রাতে নবনির্মিত এ ভবনের ছাদ ঢালাই করেন ঠিকাদার। বিকেল ৩টা থেকে কাজ শুরু করে রাত ১২টা পর্যন্ত চলে। পরদিন সকালে আমরা কলেজে এসে দেখি ছাদের কাজ ভালো হয়নি। ছাদে পানি ঢাললে ছাঁকনির মতো পানি নীচে পড়ে যায়। কংক্রিটগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে সংযুক্ত হয়নি। রডগুলো ছাদের উপর ভেসে রয়েছে। এ অনিয়মের প্রতিবাদ করায় তারা ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে।কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোজাম্মিল হক জাগো নিউজকে বলেন, ১ কোটি ৩৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯শ টাকা ব্যয়ে চারতলা ফাউন্ডেশনের দু`তলা পর্যন্ত বিল্ডিংটি হওয়ার কথা। কিন্তু এর কাজ অত্যন্ত নিম্নমানের হয়েছে। ফলে আমাদের কলেজের শিক্ষক ও গভর্নিং বডির সদস্যদের নিয়ে ঠিকাদার এবং প্রকৌশলীর উপস্থিতিতে মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বিশেষ করে দু`তলার ছাদ ভেঙে পুনরায় নির্মাণ করতে হবে।হবিগঞ্জ শিক্ষা প্রকৌশল অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের কোনো কাজই এমন হয়নি। এটি যে কেন এমন হলো আমি বুঝতে পারিনি। ঢালাইয়ের সময় আমি বার বার উপস্থিত শিক্ষকদের দেখিয়েছি। কিন্তু তার পরও এমন হওয়ার কারণ এ কাজের আমাদের যে মিস্ত্রি ছিলেন তিনি তেমন দক্ষ ছিলেন না। আমার দৃষ্টিতে এমনটিই মনে হয়েছে। তার লোকবলও তেমন বেশি ছিল না। খুব কম ছিল। ফলে সময়মতো ঢালাই মিলাতে পারেনি। এ জন্যই ছাদ থেকে পানি পড়ছে।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঠিকাদার মো. আব্দুল আওয়াল কাজের কিছু ত্রুটির কথা স্বীকার করে জাগো নিউজকে বলেন, ছাদ ঢালাইয়ের পর গ্রাউডিং (সিমেন্টের প্রলেপ) দিতে হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের বাঁধার কারণে তা না দিতে পারায় ছাদ দিয়ে পানি পড়ছে। ফলে ছাদটি অপরিপূর্ণ রয়ে গেছে। আমি কাজে কোনো খারাপ ইট, সিমেন্ট ব্যবহার করিনি। তিনি বলেন, এতবড় একটি কাজে কিছু ত্রুটি হতেই পারে। বালু কম দেয়ায় কংক্রিটের মাথাগুলো বেড়িয়ে গেছে। তাও আমি বলেছি সেটি মেরামত করে দেব। কিন্তু তারা কোনো কাজ করতে দেয় না।জানতে চাইলে এ বিল্ডিং নির্মাণ কাজের দায়িত্বরত হবিগঞ্জ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী প্রদীপ কান্তি রায় কাজে কোনো ত্রুটি নাই দাবি করে জাগো নিউজকে বলেন, আমি কলেজ পরিদর্শন করেছি। ছোট একটি অংশ দিয়ে পানি পড়ার অভিযোগ পেয়েছি। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম কোনো পানি পড়ছে না। রডের দু’একটি মাথা বের হতেই পারে। এটি পরে সিমেন্ট, বালি দিয়ে আমরা ঢেকে দেব। কোথাও কোনো কম কাজ হয়নি।কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মাহবুব আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জাগো নিউজকে জানান, দ্বিতীয় তলার কাজ শুরু হওয়ার পূর্বে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। সংসদ অধিবেশন থাকার কারণে যেতে পারেননি। তবে শুনেছেন কী ঝামেলা হয়েছে। তিনি গিয়ে দেখবেন বলে জানান।এ ব্যাপারে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের মৌলভীবাজার জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ নাছিম রেজা জাগো নিউজকে বলেন, আমি বিষয়টি শুনার পর ঠিকাদারের পেমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছি। সরেজমিনে যেকোনো ধরণের অনিয়ম পেলে অবশ্যই আমি ব্যবস্থা নেব। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।কলেজ সূত্রে জানা যায়, এ কলেজে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ১৭০০ জন। শিক্ষক আছেন ৩৩ জন। আর কর্মচারীর সংখ্যা ১০ জন। কলেজটিতে এইচএসসি, ডিগ্রি কোর্স ছাড়াও ৩টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু রয়েছে।সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন/এমজেড/এমএস
Advertisement