মাঝে একটু কলঙ্কের কালিমা না লাগলে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগটায় (বিপিএল) হয় তো ছেদ পড়তো না। ক্রিকেটের সর্বশেষ সংস্করণ টি-টোয়েন্টির চার-ছক্কার আনন্দচ্যুতও হতে হতো না দর্শকদের; কিন্তু ক্রিকেট আর ফিক্সিংয়ের ওই যে গলাগলি ধরে হাঁটা তার ব্যত্যয় হয়নি বাংলাদেশেও। মোহাম্মদ আশরাফুল আর লু ভিনসেন্টসহ কয়েকজনের ফিক্সিং কেলেঙ্কারির সঙ্গে ক্রিকেটারদের পাওনা নিয়ে আয়োজক-ফ্রাঞ্চাইজিদের নয়-ছয় মিলেই ছন্দপতন বিপিএলের। না হলে শনিবার থেকে শুরু হতে যাওয়া বিপিএল এর আসরটি পঞ্চম না হয়ে হতে পারতো ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম।
Advertisement
দেশের ক্রিকেটামোদীরা অবশ্য ওসব নিয়ে এখন আর বসে নেই। তারা ইতিমধ্যেই কাগজ-কলম হাতে নিয়ে বসে গেছেন চার-ছক্কার হিসেব রাখতে। প্রস্তুত হয়েছেন ক্রিকেটের দানবীয় কিছু ইনিংস দেখতে। হৃৎকম্পন এনে দেয়া বোলিং দেখতে। এক কথায় ক্রিকেটস্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন পুরো দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা।
২০১২ সালে যাত্রা শুরু করা বিপিএল ইতিমধ্যেই বিশ্বের অনেক ঘরোয়া ক্রিকেটকে ছাড়িয়ে গেছে। জাঁকজমকতার দিক দিয়ে ভারতের আইপিএলের পরই এখন ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের বিপিএল এর অবস্থান। বিপিএল এর পঞ্চম আসরে বিদেশি ক্রিকেটারদের কোটা বেড়েছে। এবার দলগুলো নিতে পারছে ৫জন করে বিদেশি। ব্যাট-বলের লড়াইটা তাই এবার একটু বেশিই জমবে।
পঞ্চম বিপিএল উপহার দিচ্ছে নতুন এক ভেন্যু। এই প্রথম সিলেটবাসী ঘরের মাঠে বসে দেখতে পারবে ক্রিকেটের সবচয়ে জম্পেস আয়োজন। মারকুটে ব্যাটিং আর আগুনের ফুলকি ছড়ানো বোলিংয়ে প্রায় দেড় মাস বুঁদ হয়ে থাকবে দর্শক। সিলেটে প্রথম বিপিএল এর উম্মাদনার ঝড়তো শুরু বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই।
Advertisement
টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারি- এসবই বুঝিয়ে দিচ্ছেন সিলেটবাসী তাদের প্রথম আয়োজনকে কিভাবে বরণ করে নিতে যাচ্ছে। আরো একদিক দিয়ে সৌভাগ্যবান এ শহরের মানুষ। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ আগে কখনো ঢাকার বাইরে থেকে যাত্রা করেনি। সিলেটই ঢাকার বাইরের প্রথম শহর যেখান থেকে শুরু হচ্ছে বিপিএল।
শুরুটা সিলেটে হলেও শেষমঞ্চ তৈরি থাকবে ঢাকায়। হোম অব ক্রিকেট মিরপুরই পঞ্চমবারের মতো বুকে ধারণ করবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফাইনাল। তবে তার আগে শেরে বাংলা স্টেডিয়াম একবার ঘুরে যাবে বিপিএল। সিলেটের পরই ঢাকায় হবে খেলা। তারপর চলে যাবে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। সেখান থেকেই ঢাকা ফিরবে সমাপনীর জন্য।
এবারের বিপিএল শুরুর আগে অবশ্য দেশের ক্রিকেটামোদীদের মন একটু গোমড়া। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের ব্যর্থতার ঘা এখনো দগদগে ক্রিকেটারদের গায়ে। দেশের ক্রিকেটভক্তরা ঘরে বসে দেখেছেন সাবিক-তামিমদের হতাশ করা কিছু দিন। এখন তাদের মুখে নিশ্চয় হাসি ফোটাতে মুখিয়ে আছেন ক্রিকেটাররা!
শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের দিকেই তাকিয়ে থাকবে না দর্শক। বিশ্বের অনেক মারুকুটে ব্যাটসম্যানও যে ব্যাটে ধার দিচ্ছেন বোলারদের কুমড়ার মতো ফালাফালা করে কাটতে। আবার বলে আগুনের ফুলকি ছোটাতেও তৈরি হচ্ছেন অনেকে। ব্যাট-আর বলের দুর্দান্ত সংঘর্ষেই তৈরি হবে দর্শকদের প্রাণ জুড়ানো সব উপাদান। তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আসল মজাতো চার-ছক্কাতেই। কার কার ব্যাট থেকে চার আর ছয়ের ফুলঝুড়ি বের হবে এখন সেটাই দেখার পালা।
Advertisement
চিটাগাং ভাইকিংস, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স, ঢাকা ডায়নামাইটস, খুলনা টাইটান্স, রাজশাহী কিংস, রংপুর রাইডার্স ও সিলেট সিক্সার্স- এই ৭ দলের ধুন্ধুমার লড়াইয়ের পর শেষ হাসি ফুটবে কাদের মুখে তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে প্রতি ম্যাচ থেকে চার-ছক্কার মজা নিতে দর্শকদের নিশ্চয় তর সইবে না!
সিলেটের দর্শকদের এ তৃষ্ণা হয়তো প্রথম দিনই মেটাবেন ক্রিস গেইল, কুমার সাঙ্গাকারা আর শহিদ আফ্রিদিরা। তবে সিলেটের মানুষ নিশ্চয় প্রত্যাশা করবেন না কুমার সাঙ্গাকারা আর শহিদ আফ্রিদির ব্যাটে রানের বন্যা ডাকুক। ঢাকা ডায়নামাইটসের এ দুই ক্রিকেটারের ব্যাট হাসা মানেই তো সিলেটবাসীর চোখে পানি।
ঘরের মাঠে তাদের দল সিলেট সিক্সার্সের যে ঢাকার সঙ্গেই খেলা। বরং তারা মাশরাফি বিন মর্তুজার রংপুর এবং মুশফিক-ড্যারেন স্যামির রাজশাহী কিংসের দ্রুপদি লড়াই’ই দেখতে চাইবেন। সিলেটিদের জন্য দুঃসবাদ হচ্ছে রংপুরের গেইল এবং ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ব্যাটিং তারা দেখবে না। কারণ, সিলেট পর্বে তারা দলের সঙ্গে যোগ দেবে না। যোগ দেবেন ঢাকা থেকে। তবে মালিঙ্গার বোলিং ঝড় দেখবেন সিলেটবাসী। তিনি যে ইতিমধ্যেই সিলেটে পৌঁছে গেছেন রংপুরের হয়ে মাঠ কাঁপাতে!
দেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে পুরোপুরি বিপিএলম্যান হয়ে গেছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। এ পর্যন্ত হওয়া চারটি আসরের তিনটি ট্রফিই যে উঠেছে তার হাতে! প্রথম দুটি ঢাকার আর তৃতীয়টি কুমিল্লার অধিনায়ক হয়ে। বাকিটি উঠেছে সাকিব আল হাসানের হাতে, সর্বশেষ আসরে ঢাকার অধিনায়ক হয়ে।
এবার কার হাতে উঠবে ট্রফি? মাশরাফির চতুর্থ নাকি সাকিবের দ্বিতীয়। নাকি প্রথমবারের মতো তামিম ইকবাল নাচবেন ট্রফি হাতে। এ নাচন দেখার আগে অবশ্য অনেক নাচতে হবে দর্শকদের। তাদের নাচাবেন ওই তামিম, সাকিব, কিংবা মাশরাফিরাই। আঞ্চলিক দর্শকদের মনে থাকবে নিজ দলের বিজয় দেখার বাসনা; কিন্তু যাদের কোনো দল নেই?
যারা কেবল কোনো এক ক্রিকেটারের জন্য বেছে নেবেন পছন্দের দল? তাদের কাছে কিন্তু শেষ দিনের ট্রফি জয়ের চেয়ে প্রতিদিনের চার-ছক্কাই হবে বেশি আনন্দের। সেই চার-ছক্কার ডালা সাজিয়েই রেখেছে বিপিএলের এবারের আসর।
এখন শুধু অপেক্ষ। সিঙ্গেল, ডাবলস কিংবা তিন রান নয়-যেখানে প্রধান আকর্ষণই হবে চার-ছয়। গ্যালারিতে তখন দর্শকরা গলা মিলিয়ে বেসুরে গাইবেন; ‘ছার-ছক্কা হৈ হৈ বল গড়াইয়া গেলো কই ‘ ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অফিসিয়াল ইভেন্টের থিম সংটিই হয়তো কয়দিনের জন্য আবার সবার ঠোটে থাকবে ক্রিকেটের গান হয়েই।
আরআই/আইএইচএস/আইআই