মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রতিবছর বহু বাংলাদেশি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছেন। তাদের পাঠানো রেমিটেন্সে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকই থেকে যাচ্ছেন তারা। নিজেদের জীবনমানের কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
Advertisement
তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। যারা নিজেদের যোগ্যতায় বাংলাদেশকে পরিচিত করছেন সারা বিশ্বে। এমনই একজন যশোরের মনিরামপুর উপজেলার মো. মোস্তাফিজুর রহমান (২৯)। যিনি নিজের অধ্যবসায় দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করতে সক্ষম হয়েছেন। অনেকের কাছেই এখন তিনি রোলমডেল।
অন্যান্য বাংলাদেশির মতই শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে কুয়েতে পাড়ি জমিয়েছিলেন তরুণ মোস্তাফিজ। শুরু করেছিলেন গাড়ি চালানোর কাজ। কিন্তু এই পেশাতেই থেমে থাকতে চাননি তিনি। কঠোর পরিশ্রম আর পড়াশুনা করে নিজেকে যোগ্য করে তুলেছেন। এখন রীতিমতো কুয়েতের গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজের সাফল্য গাঁথা জানাতে হচ্ছে তাকে।
নিজের এ সাফল্য সম্পর্কে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তার বাবার নাম লুৎফর রহমান। মনিরামপুরের শিরালী মদনপুর গ্রামে তাদের বাড়ি। ২০০৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন। স্বপ্ন ছিল হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেবেন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় টিকলেও বড় ছেলে হওয়ায় তার কাঁধে এসে পড়ে পরিবারের দায়িত্ব। তাই ২০০৬ সালে কুয়েতে পাড়ি দেন তিনি। কুয়েতে এসে বাসার গাড়ি চালকের চাকরি শুরু করেন। কঠোর পরিশ্রম আর সততার বলে খুব দ্রুতই ওই পরিবারের সবার মন জয় করে নেন। সারা দিন গাড়ি চালালেও মোস্তাফিজের লেখাপড়া করার ইচ্ছাটা তখনো শেষ হয়ে যায়নি।
Advertisement
একদিন সাহস করে মনের কথা বলেই ফেললেন কুয়েতি মালিককে। হৃদয়বান সেই কুয়েতি ভদ্রলোক শুনে খুশিই হলেন। দীর্ঘ সাত বছর চালক হিসেবে কাজ করার পর ২০১৩ সালে লেখাপড়ার সুযোগ পেলেন মোস্তাফিজুর। কুয়েতি মালিক তাকে কাজ আর পড়াশোনা দুটোরই সুযোগ করে দেন।
এর আগে অবশ্য বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া সার্টিফিকেটগুলো বাংলাদেশের শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশে অবস্থিত কুয়েত দূতাবাস, কুয়েতের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কুয়েতে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসসহ দুই দেশের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সত্যায়িত করে রাখেন।
২০১৩ সালে আরব ওপেন ইউনিভার্সিটির অধীনে যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়েত শাখায় বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন অ্যাকাউন্টিংয়ে ভর্তি হন মোস্তাফিজ। শুরু হলো তার জীবনের আরেক যুদ্ধ।
মোস্তাফিজ জানান, এমবিএ শেষ করার পর সার্টার একাউন্টিংএ পিএইচডি করতে উদ্যোগী হই। যা বেতন পেতাম, তার প্রায় পুরোটাই চলে যেত সেমিস্টার ফি দিতে। বাড়িতে ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারতাম না। তবে এ সময় পাশে ছিল তার পরিবার। টাকার জন্য কখনও চাপ দেয়নি। সারাদিন ওই কুয়েতি মালিকের বাসার গাড়ি চালান। বিকেলে ক্লাস করতে যান। এরপর ঘরে ফিরে প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে হয়, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। সব মিলিয়ে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়। তারপর আবার ভোর থেকে শুরু হয় নিয়মিত জীবন। ফলে রোজ তিন-চার ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারতেন না। তবু থেমে থাকেননি তিনি। নিজের স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে কঠোর পরিশ্রম করেছেন; কিন্তু হাল ছাড়েননি।
Advertisement
অবশেষে এই পরিশ্রমের ফল পেয়েছেন মোস্তাফিজ। ৪ বছরের সম্মান কোর্স শেষ করেছেন মাত্র সাড়ে তিন বছরে। তাও প্রায় ৮৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে। এ ফলাফলের পর স্থানীয় গণমাধ্যমে মোস্তাফিজকে নিয়ে সংবাদ প্রচারের হিড়িক পড়ে যায়। কুয়েতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেলে তার সাফল্যের কথা জানতে সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। পড়াশোনা তো শেষ হলো, এবার কী করতে চান মোস্তাফিজুর রহমান? এর পরের লক্ষ্য সর্ম্পকে তিনি বলেন, সম্মানজনক একটা চাকরি করা। এভাবেই একটু একটু করে নিজেকে গুছিয়ে নিতে চান টগবগে এই তরুণ।
এমএমজেড/আইআই