খেলাধুলা

বিপিএলে অধিনায়ক মাশরাফির অনুপম কীর্তি

ক্রিকেটার মাশরাফি, মানুষ মাশরাফি না অধিনায়ক মাশরাফি- কে বেশি বড়? তা নিয়ে একটা ছোটখাট বিতর্ক হতেই পারে। সে বিতর্কে ঠিক কোন মাশরাফির অনুসারি বা ভক্তরা জিতবেন তা বলা মুশকিল। কারণ নড়াইলের মধ্য তিরিশে পা রাখা এ সহজ সরল কিন্তু প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও তীক্ষ্ণ ক্রিকেট বোধ সম্পন্ন মানুষটির তিন সত্তার কোনটাই কোনোটার চেয়ে কম নয়। তিনটিই সমান বড়।

Advertisement

ক্রিকেটার মাশরাফি অনেক বড়। ইনজুরি বাঁধা হয়ে না দাঁড়ালে পরিসংখ্যানই তাকে নিয়ে যেতো বিশ্বমানে। যে মাশরাফির ওয়ানডে উইকেট ২৩২। তা হয়ত সাড়ে তিনশো’ ছাড়িয়ে যেত। নামের পাশে টেস্ট উইকেট যেখানে (৩৬ টেস্টে ৭৮) তা সন্দেহাতীত ভাবেই ২০০‘র বেশি থাকতো।

তার ব্যাটিংয়ের কথা বলা হয়নি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে এখন হাফ সেঞ্চুরি মোটে একটি। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৫১। বললে অত্যুক্তি হবে না, বারবার ইনজুরিতে আক্রান্ত মাশরাফি যদি আট-নয়বার অপারেশনের টেবিলে না যেতেন, তার ধকল কাটাতে রিহ্যাবে যদি ক্যারিয়ারের স্বর্ণ সময়ের দুই থেকে তিন বছর নষ্ট না হতো- তাহলে আজকে শুধু বোলার মাশরাফির পরিসংখ্যানই সমৃদ্ধ হতো না। তার ব্যাটিং ক্যারিয়ারও অনেক সমৃদ্ধ হতো। কে জানে পুরোদস্তুর একজন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার বনে যেতে পারতেন তিনি।

কারণ, ক্যারিয়ারের শুরুতে মানে অনূর্ধ-১৭ জাতীয় দলে প্রথম সুযোগ পাওয়া মাশরাফির ব্যাটের ধারও ছিল বেশ। আরব আমিরাতের বিপক্ষে এক ম্যাচে ১৬/১৭ বলে চার ও ছক্কার ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে ৬৮ রানের ইনিংসে ছিল সেই ইঙ্গিত। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুতেও বল হাতে দুরন্ত মাশরাফি ব্যাটেও রান করেছেন নিয়মিত।

Advertisement

কিন্তু একের পর এক ইনজুুরি ব্যাটের সে ফলগুধারা কেড়ে নিয়েছে। অমিত সম্ভাবনাময় অলরাউন্ডার মাশরাফি ধীরে ধীরে বনে যান পেসার মাশরাফিতে। এখন ওয়ানডেতে একটি মাত্র হাফ সেঞ্চুরি দেখে অনেকেই বিশ্বাস করবেন না, অনূর্ধ ১৭ ও অনুর্ধ ১৯‘এ খেলার সময় মাশরাফির ব্যাট কত উত্তাল ছিল! ইনজুরিতে শেষ হয়ে যাওয়া টেস্ট ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যানও জানান দিচ্ছে, ব্যাটসম্যান মাশরাফিও ফেলনা ছিলেন না; টেস্টে তার তিনটি হাফ সেঞ্চুরি আছে।

ক্রিকেটে যেহেতু পরিসংখ্যানই শেষ কথা। মেধা, যোগ্যতা ও সামর্থ্য মাপার মূল মানদণ্ড- তাই পরিসংখ্যানই বলে দিত, মাশরাফি অনেক বড় পারফরমার। বিশ্ব মানের ক্রিকেটার।

মানুষ মাশরাফির কথা বলে শেষ করা যাবে না। যতটা বিনয়, নম্ররতা, ভদ্রতা জ্ঞান সৌজন্যতাবোধ থাকলে একজন মানুষকে সত্যিকার ‘ভদ্রলোক’ বলা হয়- মাশরাফির ভিতরে তার সবটুকুই আছে। ঠেটের কোনে সব সময় হাসি লেগে থাকবে। বড়দের সম্মান, ছোটদের স্নেহ ভালবাসায় সিক্ত করায় তার জুড়ি মেলা ভার।

মানুষ মাশরাফি খুব ভাল আর তার মানবিক গুণাবলি অনেক বেশি বলেই তো অধিনায়ক মাশরাফি আরও বড়। একজন খুব ভাল ব্যাটসম্যান, নিয়মিত রান করেন। দলের নির্ভরতার প্রতীক। আরেকজন দারুন বোলার; প্রায় প্রতি খেলায় দলকে নিয়মিত উইকেট উপহার দেন। প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপে কাঁপন ধরান। সমীহ আদায় করেন। এমন দুই গুণ থাকলেই তাকে অধিনায়ক করা হবে, তিনিই দল পরিচালনা করবেন, নেতৃত্ব দেবেন- এমন নয়।

Advertisement

ক্রিকেট ‘অধিনায়কত্ব’ শব্দটার ব্যাপ্তি, গভীরতা আরও অনেক বেশি। অধিনায়ক কেমন পারফরমার, তার ব্যাটিং ও বোলিং সামর্থ্য কেমন? তার চেয়েও বড় হলো তার নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা কতটা? তিনি দলকে কতটা উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। তার উপস্থিতি সহযোগিদের ভাল খেলায় কতটা অনুপ্রাণিত করে, তার ক্রিকেট বুদ্ধি সাহস কেমন।

সর্বোপরি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি কেমন কার্যকর ও দুরদর্শি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন- সংক্ষেপে এগুলোই একজন প্রকৃত ও আদর্শ অধিনায়কের অপরিহার্য গুণাগুন। তার শতভাগ না থাকলেও অনেকটাই আছে মাশরাফির মধ্যে। তার সান্নিধ্য পছন্দ করেন সহযোগি সবাই। বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের কাছে মাশরাফি ‘বড় ভাই’। অভিভাবক, বড় নির্ভরতা ও স্বস্তির প্রতীক। ব্যক্তি জীবনে উদার বলেই তামিম, মুশফিক ও সাকিবের মত মাঠ মাতানো আর চারিদিক আলোকিত করা পারফরমারও মাশরাফি ভাই বলতে অজ্ঞান।

সবাই মাশরাফির সান্নিধ্য পছন্দ করেন। তার নেতৃত্বে অবিচল আস্থা সবার। সবাই জানেন, ‘মাশরাফি ভাই সুখে-দুঃখে আমাদের সঙ্গী’। সু-সময়ে যেমন দুঃসময়েও তেমনি কাছে থাকেন। থাকবেন। আগলে রাখবেন। ভাল করায় অনুপ্রেরণা জোগাবেন।

মাশরাফি ভাই বল ও ব্যাট হাতে কি করলেন, তা নিয়ে তেমন কারো মাথা ব্যাথা নেই। পারফরমার মাশরাফির চেয়ে বড় ভাই মাশরাফি ভাই তাদের অনেক বেশি পছন্দের। ভালবাসার। ভাললাগার।

তামিম, মুশফিক, সাকিব-মাহমুদউল্লাহর মত মেধাবি ও নৈপুণ্যেও দ্যুতি ছড়ানো পারফরমারদের প্রিয় অধিনায়ক মাশরাফি। আবার বর্তমান প্রজন্মের সৌম্য, সাব্বির, নাসির, মিরাজ, মোস্তাফিজ ও তাসকিনদেরও প্রিয় বড় ভাই, অভিভাবক মাশরাফি। তাই মাশরাফি দলে থাকা মানেই, পুরো দল এক পরিবার হয়ে যাওয়া।

সহযোদ্ধাদের সাহস জোগানো, ভাল খেলায় অনুপ্রাণিত- উদ্বুদ্ধ করায় মাশরাফির যে জুড়ি নেই, তার প্রমাণ গত চার বছওে সবচেয়ে বেশি ওয়ানডে ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ। বলার অপেক্ষা রাখে না এই পুরো সময়ই মাশরাফি ছিলেন অধিনায়ক। একইভাবে বিপিএলেও অধিনায়ক মাশরাফি সবার সেরা।

আহামরি পারফরমেন্স নেই। বল ও ব্যাট হাতে এমন কিছু করেননি, যা এক কথায় সরণীয় হয়ে আছে; কিন্তু অধিনায়ক মাশরাফি বিপিএলে এমন এক কীর্তি গড়ে ফেলেছেন, যা টপকে যাওয়া বহুদুরে- ছোঁয়াই কঠিন।

পরিসংখ্যান পরিষ্কার জানান দিচ্ছে , বিপিএলের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মাশরাফি। প্রথম তিন আসরের চ্যাম্পিয়ন দলের ক্যাপ্টেন নড়াইলের এ সাহসী সেনাপতি। তার নেতৃত্বে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স বিপিএলের প্রথম দু’বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সও তৃতীয় বিপিএলে শেষ হাসি হাসে মাশরাফির হাত ধরেই। আর কোন অধিনায়কের এমন সাফল্য বা কীর্তি নেই। বিপিএলে ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ তারকা ছাড়া প্রায় সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের নামি-দামি তারকারাই অংশ নেন এতে। সেখানে বিদেশি ক্রিকেটারদের প্রাধান্যই থাকে বেশি। এর মধ্যেও মাশরাফি সফলতম অধিনায়ক।

মাশরাফির মাঝে একটা অদ্ভূত সন্মোহনি ক্ষমতা আছে। যা তাকে কাছে টানে। দেশি ক্রিকেটারদের পাশাপাশি অনেক নামি-দামি তারকাও মুগ্ধ হন তার ব্যক্তিত্বে। সে কারণেই সবার সাথে একটা অপূর্ব মেলবন্ধন গড়ে ওঠে তার এবং টিম স্পিরিট তৈরি হয়। সেটাই সাফল্যের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।

পরপর তিন বিপিএলের ফাইনালে প্রধান অতিথির হাত থেকে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নেয়া গর্বিত অধিনায়ক মাশরাফি শুধু গতবারই শেষ হাসি হাসতে পারেননি। তার নেতৃত্বে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ২০১৬ সালে শেষ চারেও নাম লেখাতে পারেনি।

সেবারের স্মৃতিও তেমন সুখের নয়। টিম ম্যানেজমেন্ট ও ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সাথে মনোমালিন্যর কারণে খেলার দিন টিম হোটেল ছেড়ে ঘরে ফেরত আসার তিক্ততাও ছিল সঙ্গী। এবার দল পাল্টে নতুন শিবিরে মাশরাফি। রংপুর রাইডার্সের অধিনায়ক তিনি।

তার নেতৃত্বে ক্রিস গেইল, ব্রেন্ডন ম্যাককালামের মত সীমিত ওভারের ক্রিকেটের দুই সফলতম ও যারপরনাই কার্যকর উইলোবাজ মাঠে নামবেন। আর সাথে দীর্ঘ দিনের সহযোদ্ধা শাহরিয়ার নাফীস, আব্দুর রাজ্জাক ও জিয়াউর রহমানরাও আছেন।

কাগজে কলমে অন্যতম সমৃদ্ধ দল। কারো কারো মতে এক নম্বর দল। তিন-চার নম্বর দলও যার নেতৃত্ব গুণে পাল্টে যায়, ভাল খেলতে দৃঢ় সংকল্পব্ধ হয়ে ওঠে এক নম্বর হয়ে যায়- সেই মাশরাফির নেতৃত্বে এবার কি করবে রংপুর রাইডার্স?

গতবার না পারা মাশরাফি ১২ ডিসেম্বর রাতে হোম অব ক্রিকেট শেরে বাংলায় আবার কাপ উঁচিয়ে শেষ হাসি হাসবেন? সেটাই এখন দেখার।

আইএইচএস/পিআর